10:32 am, Sunday, 21 December 2025

বীমা খাতে আস্থার ভাঙন – কর্তৃপক্ষের নীরব ভূমিকা

এম হোসাইন আহমদ:

Picsart 25 12 14 21 09 31 070

 

“বকেয়া দাবি, নিয়ম বহির্ভূত ব্যয় ও দুর্বল নিয়ন্ত্রণে কোন পথে জীবন ও নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স শিল্প”

এম হোসাইন আহমদ:
বাংলাদেশের বীমা খাত দীর্ঘদিন ধরে একটি নীরব সংকটের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। বাইরে থেকে এই খাতকে কখনো কখনো স্থিতিশীল কিংবা উন্নয়নশীল বলে মনে হলেও ভেতরের চিত্র ভিন্ন। জীবন বীমা ও নন-লাইফ বীমা দুই ক্ষেত্রেই গ্রাহকের প্রাপ্য দাবি সময়মতো পরিশোধ না হওয়া, নিয়ম বহির্ভূত ব্যয়, অতিরিক্ত কমিশন এবং দুর্বল তদারকি এই শিল্পকে ক্রমশ আস্থাহীনতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বীমা এমন একটি খাত, যার ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বাসের ওপর। অথচ সেই বিশ্বাসই আজ সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ।

চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে জীবন বীমা খাতে উত্থাপিত দাবির পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বাস্তবতা হলো, এর একটি বড় অংশ এখনো পরিশোধ হয়নি। এই বকেয়া কেবল হিসাবের খাতায় আটকে থাকা কোনো সংখ্যা নয়। এর প্রতিটি টাকার পেছনে রয়েছে একজন গ্রাহক, একটি পরিবার, কোনো না কোনো দুঃসময়। জীবন বীমার দাবি সাধারণত আসে মৃত্যু, দুর্ঘটনা বা গুরুতর অসুস্থতার পর। অর্থাৎ, এই দাবির অর্থ সময়মতো না পাওয়া মানে একটি পরিবারকে আরও বড় সংকটে ঠেলে দেওয়া।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বকেয়া দাবির বড় অংশই কয়েকটি নির্দিষ্ট জীবন বীমা কোম্পানির কাছে আটকে আছে। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে পুরো খাতের সমস্যা নয়, বরং কিছু প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘদিনের দুর্বল ব্যবস্থাপনা, আর্থিক অনিয়ম ও জবাবদিহিতার অভাব পুরো শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এই কোম্পানিগুলো নিয়মিত প্রিমিয়াম সংগ্রহ করলেও দাবি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে চরম উদাসীনতা দেখাচ্ছে।

জীবন বীমা গ্রাহকদের অভিযোগ প্রায় একই ধরনের। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেওয়ার পরও মাসের পর মাস কোনো অগ্রগতি নেই। কেউ কেউ বারবার অফিসে গিয়ে আশ্বাস ছাড়া কিছুই পান না। আবার কোথাও আংশিক অর্থ দিয়ে পুরো দাবি মেটানোর নামে সময়ক্ষেপণ করা হয়। এই প্রবণতা শুধু গ্রাহকের কষ্ট বাড়াচ্ছে না, বরং নতুন করে বীমা নেওয়ার প্রবণতাও কমিয়ে দিচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দাবি পরিশোধে এই সংকটের পেছনে অন্যতম কারণ হলো আর্থিক শৃঙ্খলার অভাব। অনেক কোম্পানি প্রিমিয়ামের অর্থ দিয়ে প্রশাসনিক ব্যয়, বিপণন ব্যয় কিংবা অন্যান্য খাতে অতিরিক্ত খরচ করছে, কিন্তু দাবি পরিশোধের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল সংরক্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অদক্ষ ও প্রশ্নবিদ্ধ ব্যবস্থাপনা কাঠামো।

জীবন বীমা শিল্পের পাশাপাশি নন-লাইফ বীমা খাতেও একই ধরনের অনিয়ম ও সংকট বিদ্যমান। অগ্নিকাণ্ড, দুর্ঘটনা, শিল্প ঝুঁকি কিংবা বাণিজ্যিক ক্ষতির ক্ষেত্রে নন-লাইফ বীমা অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবে এই খাতে দাবি নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া এতটাই জটিল ও দীর্ঘ যে অনেক উদ্যোক্তা বীমার ওপর আস্থা হারাচ্ছেন।

নন-লাইফ বীমা খাতে নিয়ম বহির্ভূত কমিশন ও অতিরিক্ত ব্যয়ের অভিযোগ বহুদিনের। নীতিমালায় নির্ধারিত সীমা থাকলেও বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না এমন অভিযোগ খাত সংশ্লিষ্টদের। কমিশনের নামে বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত কোম্পানির আর্থিক সক্ষমতাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। এর প্রভাব সরাসরি পড়ে দাবি পরিশোধে।

এই প্রেক্ষাপটে ডিজিটালাইজেশনের বিষয়টি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। অনেক নামিদামি জীবন ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানি নিজেদের আধুনিক ও সম্পূর্ণ ডিজিটাল প্রতিষ্ঠান হিসেবে উপস্থাপন করছে। অনলাইন পলিসি, ডিজিটাল ক্লেইম, সফটওয়্যারভিত্তিক ব্যবস্থাপনা নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী উদ্যোগ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই ডিজিটাল ব্যবস্থাগুলো কি সত্যিই স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বাড়াচ্ছে, নাকি অনিয়মের নতুন রূপ তৈরি করছে।

ডিজিটাল সিস্টেমের নামে আইটি অবকাঠামো, সফটওয়্যার লাইসেন্স, সার্ভার ও ডিজিটাল মার্কেটিং খাতে বড় অঙ্কের ব্যয়ের অভিযোগ উঠছে। অনেক ক্ষেত্রে এই ব্যয়ের বাস্তব উপযোগিতা বা প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট নয়। প্রযুক্তি ব্যবহারের নামে যদি আর্থিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে, তাহলে তা ডিজিটাল অগ্রগতি নয়, বরং নিয়ন্ত্রিত অনিয়মে পরিণত হয়।

খাত সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, কিছু প্রতিষ্ঠানে মালিক পক্ষের প্রভাব এতটাই বেশি যে পেশাদার ও স্বাধীন ব্যবস্থাপনার সুযোগ সংকুচিত হয়ে গেছে। কিছু শীর্ষ নির্বাহী নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের পথ বেছে নিচ্ছেন এমন অভিযোগও রয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানের ভেতরে জবাবদিহিতা দুর্বল হচ্ছে এবং অনিয়মের সংস্কৃতি টিকে যাচ্ছে।

এই অবস্থায় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আইন অনুযায়ী এই সংস্থার দায়িত্ব হলো বীমা শিল্পের শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা, গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষা করা এবং কোম্পানিগুলোর ওপর কার্যকর নজরদারি চালানো। কিন্তু বাস্তবে বড় অঙ্কের অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও অনেক সময় শাস্তি সীমাবদ্ধ থাকে সামান্য জরিমানায়। এতে অনিয়ম বন্ধ হওয়ার বদলে বরং একটি বার্তা যায় যে বড় দুর্নীতির ঝুঁকি নেওয়াও লাভজনক।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার জিরো টলারেন্স নীতি কাগজে থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই। অযোগ্য ও প্রশ্নবিদ্ধ শীর্ষ নির্বাহীদের অপসারণ, আর্থিক অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার অভ্যন্তরীণ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা ছাড়া এই সংকট কাটবে না।

জীবন বীমা খাতে আস্থা ফেরাতে হলে প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো দাবি পরিশোধকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া। দাবি নিষ্পত্তির জন্য আলাদা তহবিল সংরক্ষণ, নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া এবং তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা জরুরি। একই সঙ্গে কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে গ্রাহক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা উভয়েই প্রকৃত অবস্থা জানতে পারে।

নন-লাইফ বীমা খাতে কমিশন ও ব্যয়ের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি। নিয়ম বহির্ভূত ব্যয় বন্ধ না হলে কোনো সংস্কারই টেকসই হবে না। পাশাপাশি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও রি ইন্স্যুরেন্স ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে, যাতে বড় ক্ষতির সময় কোম্পানিগুলো গ্রাহকের দায় পালন করতে পারে।

সবশেষে বলা যায়, বীমা খাত কোনো বিলাসী ব্যবসা নয়। এটি মানুষের জীবনের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। গ্রাহকের প্রাপ্য অর্থ সময়মতো পরিশোধ করা কোনো দয়া নয়, এটি আইনগত ও নৈতিক বাধ্যবাধকতা। এই দায় পালনে ব্যর্থ হলে শুধু কোম্পানিগুলোই নয়, নিয়ন্ত্রক সংস্থাও প্রশ্নের মুখে পড়বে। বীমা খাতের উন্নয়ন মানে শুধু প্রিমিয়াম সংগ্রহ বাড়ানো নয়, বরং আস্থা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। এই তিনটি ভিত্তি মজবুত না হলে উন্নয়নের সব দাবি শেষ পর্যন্ত কাগুজে প্রচারণায় সীমাবদ্ধ থাকবে।

লেখক:

এম হোসাইন আহমদ:

সাংবাদিক ও বীমা বিশ্লেষক:
প্রচার সচিব, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা৷

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

Update Time : 03:13:27 pm, Sunday, 14 December 2025
116 Time View

বীমা খাতে আস্থার ভাঙন – কর্তৃপক্ষের নীরব ভূমিকা

Update Time : 03:13:27 pm, Sunday, 14 December 2025

 

“বকেয়া দাবি, নিয়ম বহির্ভূত ব্যয় ও দুর্বল নিয়ন্ত্রণে কোন পথে জীবন ও নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স শিল্প”

এম হোসাইন আহমদ:
বাংলাদেশের বীমা খাত দীর্ঘদিন ধরে একটি নীরব সংকটের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। বাইরে থেকে এই খাতকে কখনো কখনো স্থিতিশীল কিংবা উন্নয়নশীল বলে মনে হলেও ভেতরের চিত্র ভিন্ন। জীবন বীমা ও নন-লাইফ বীমা দুই ক্ষেত্রেই গ্রাহকের প্রাপ্য দাবি সময়মতো পরিশোধ না হওয়া, নিয়ম বহির্ভূত ব্যয়, অতিরিক্ত কমিশন এবং দুর্বল তদারকি এই শিল্পকে ক্রমশ আস্থাহীনতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বীমা এমন একটি খাত, যার ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বাসের ওপর। অথচ সেই বিশ্বাসই আজ সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ।

চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে জীবন বীমা খাতে উত্থাপিত দাবির পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বাস্তবতা হলো, এর একটি বড় অংশ এখনো পরিশোধ হয়নি। এই বকেয়া কেবল হিসাবের খাতায় আটকে থাকা কোনো সংখ্যা নয়। এর প্রতিটি টাকার পেছনে রয়েছে একজন গ্রাহক, একটি পরিবার, কোনো না কোনো দুঃসময়। জীবন বীমার দাবি সাধারণত আসে মৃত্যু, দুর্ঘটনা বা গুরুতর অসুস্থতার পর। অর্থাৎ, এই দাবির অর্থ সময়মতো না পাওয়া মানে একটি পরিবারকে আরও বড় সংকটে ঠেলে দেওয়া।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বকেয়া দাবির বড় অংশই কয়েকটি নির্দিষ্ট জীবন বীমা কোম্পানির কাছে আটকে আছে। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে পুরো খাতের সমস্যা নয়, বরং কিছু প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘদিনের দুর্বল ব্যবস্থাপনা, আর্থিক অনিয়ম ও জবাবদিহিতার অভাব পুরো শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এই কোম্পানিগুলো নিয়মিত প্রিমিয়াম সংগ্রহ করলেও দাবি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে চরম উদাসীনতা দেখাচ্ছে।

জীবন বীমা গ্রাহকদের অভিযোগ প্রায় একই ধরনের। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেওয়ার পরও মাসের পর মাস কোনো অগ্রগতি নেই। কেউ কেউ বারবার অফিসে গিয়ে আশ্বাস ছাড়া কিছুই পান না। আবার কোথাও আংশিক অর্থ দিয়ে পুরো দাবি মেটানোর নামে সময়ক্ষেপণ করা হয়। এই প্রবণতা শুধু গ্রাহকের কষ্ট বাড়াচ্ছে না, বরং নতুন করে বীমা নেওয়ার প্রবণতাও কমিয়ে দিচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দাবি পরিশোধে এই সংকটের পেছনে অন্যতম কারণ হলো আর্থিক শৃঙ্খলার অভাব। অনেক কোম্পানি প্রিমিয়ামের অর্থ দিয়ে প্রশাসনিক ব্যয়, বিপণন ব্যয় কিংবা অন্যান্য খাতে অতিরিক্ত খরচ করছে, কিন্তু দাবি পরিশোধের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল সংরক্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অদক্ষ ও প্রশ্নবিদ্ধ ব্যবস্থাপনা কাঠামো।

জীবন বীমা শিল্পের পাশাপাশি নন-লাইফ বীমা খাতেও একই ধরনের অনিয়ম ও সংকট বিদ্যমান। অগ্নিকাণ্ড, দুর্ঘটনা, শিল্প ঝুঁকি কিংবা বাণিজ্যিক ক্ষতির ক্ষেত্রে নন-লাইফ বীমা অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবে এই খাতে দাবি নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া এতটাই জটিল ও দীর্ঘ যে অনেক উদ্যোক্তা বীমার ওপর আস্থা হারাচ্ছেন।

নন-লাইফ বীমা খাতে নিয়ম বহির্ভূত কমিশন ও অতিরিক্ত ব্যয়ের অভিযোগ বহুদিনের। নীতিমালায় নির্ধারিত সীমা থাকলেও বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না এমন অভিযোগ খাত সংশ্লিষ্টদের। কমিশনের নামে বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত কোম্পানির আর্থিক সক্ষমতাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। এর প্রভাব সরাসরি পড়ে দাবি পরিশোধে।

এই প্রেক্ষাপটে ডিজিটালাইজেশনের বিষয়টি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। অনেক নামিদামি জীবন ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানি নিজেদের আধুনিক ও সম্পূর্ণ ডিজিটাল প্রতিষ্ঠান হিসেবে উপস্থাপন করছে। অনলাইন পলিসি, ডিজিটাল ক্লেইম, সফটওয়্যারভিত্তিক ব্যবস্থাপনা নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী উদ্যোগ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই ডিজিটাল ব্যবস্থাগুলো কি সত্যিই স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বাড়াচ্ছে, নাকি অনিয়মের নতুন রূপ তৈরি করছে।

ডিজিটাল সিস্টেমের নামে আইটি অবকাঠামো, সফটওয়্যার লাইসেন্স, সার্ভার ও ডিজিটাল মার্কেটিং খাতে বড় অঙ্কের ব্যয়ের অভিযোগ উঠছে। অনেক ক্ষেত্রে এই ব্যয়ের বাস্তব উপযোগিতা বা প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট নয়। প্রযুক্তি ব্যবহারের নামে যদি আর্থিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে, তাহলে তা ডিজিটাল অগ্রগতি নয়, বরং নিয়ন্ত্রিত অনিয়মে পরিণত হয়।

খাত সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, কিছু প্রতিষ্ঠানে মালিক পক্ষের প্রভাব এতটাই বেশি যে পেশাদার ও স্বাধীন ব্যবস্থাপনার সুযোগ সংকুচিত হয়ে গেছে। কিছু শীর্ষ নির্বাহী নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের পথ বেছে নিচ্ছেন এমন অভিযোগও রয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানের ভেতরে জবাবদিহিতা দুর্বল হচ্ছে এবং অনিয়মের সংস্কৃতি টিকে যাচ্ছে।

এই অবস্থায় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আইন অনুযায়ী এই সংস্থার দায়িত্ব হলো বীমা শিল্পের শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা, গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষা করা এবং কোম্পানিগুলোর ওপর কার্যকর নজরদারি চালানো। কিন্তু বাস্তবে বড় অঙ্কের অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও অনেক সময় শাস্তি সীমাবদ্ধ থাকে সামান্য জরিমানায়। এতে অনিয়ম বন্ধ হওয়ার বদলে বরং একটি বার্তা যায় যে বড় দুর্নীতির ঝুঁকি নেওয়াও লাভজনক।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার জিরো টলারেন্স নীতি কাগজে থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই। অযোগ্য ও প্রশ্নবিদ্ধ শীর্ষ নির্বাহীদের অপসারণ, আর্থিক অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার অভ্যন্তরীণ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা ছাড়া এই সংকট কাটবে না।

জীবন বীমা খাতে আস্থা ফেরাতে হলে প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো দাবি পরিশোধকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া। দাবি নিষ্পত্তির জন্য আলাদা তহবিল সংরক্ষণ, নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া এবং তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা জরুরি। একই সঙ্গে কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে গ্রাহক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা উভয়েই প্রকৃত অবস্থা জানতে পারে।

নন-লাইফ বীমা খাতে কমিশন ও ব্যয়ের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি। নিয়ম বহির্ভূত ব্যয় বন্ধ না হলে কোনো সংস্কারই টেকসই হবে না। পাশাপাশি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও রি ইন্স্যুরেন্স ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে, যাতে বড় ক্ষতির সময় কোম্পানিগুলো গ্রাহকের দায় পালন করতে পারে।

সবশেষে বলা যায়, বীমা খাত কোনো বিলাসী ব্যবসা নয়। এটি মানুষের জীবনের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। গ্রাহকের প্রাপ্য অর্থ সময়মতো পরিশোধ করা কোনো দয়া নয়, এটি আইনগত ও নৈতিক বাধ্যবাধকতা। এই দায় পালনে ব্যর্থ হলে শুধু কোম্পানিগুলোই নয়, নিয়ন্ত্রক সংস্থাও প্রশ্নের মুখে পড়বে। বীমা খাতের উন্নয়ন মানে শুধু প্রিমিয়াম সংগ্রহ বাড়ানো নয়, বরং আস্থা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। এই তিনটি ভিত্তি মজবুত না হলে উন্নয়নের সব দাবি শেষ পর্যন্ত কাগুজে প্রচারণায় সীমাবদ্ধ থাকবে।

লেখক:

এম হোসাইন আহমদ:

সাংবাদিক ও বীমা বিশ্লেষক:
প্রচার সচিব, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা৷