9:54 pm, Thursday, 11 September 2025

সূচনা ফাউন্ডেশনে দানের নামে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের থেকে আদায় করতেন মোটা অঙ্কের টাকা: পুতুল

দিগন্ত প্রতিদিন

suchona foundation 20250911130511

বিশেষ প্রতিনিধি:
‘সূচনা ফাউন্ডেশন’ নেই অফিস, নেই কর্মী অথচ এ অস্তিত্বহীন সংস্থার দাপটে একসময় তটস্থ থাকতেন ব্যবসায়ী ও ধনাঢ্যরা। সূচনা ফাউন্ডেশন নামের ভুয়া এ সংস্থা থেকে ব্যবসায়ী ও ধনীদের সংসদ সদস্য বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে টোপ ফেলা হতো। তবে তাতে কাজ না হলে ভয়ভীতি দেখিয়ে ও চাপ প্রয়োগ করে আদায় করা হতো মোটা অঙ্কের টাকা।

এ সংস্থার চেয়ারম্যান ছিলেন গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। সূচনা ফাউন্ডেশনে অনুদান দিতে ব্যবসায়ী, চিকিৎসকসহ সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের দেওয়া হতো রাজনৈতিক চাপ, মামলার ভয় এমনকি সংসদ সদস্য বানানোর প্রলোভন। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বলছে, সূচনা ফাউন্ডেশনের কোনো অস্তিত্ব নেই। প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানায় অভিযান চালিয়ে কিছু পায়নি দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম। এরপর সূচনা ফাউন্ডেশন নামে একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান গড়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দানের নামে ঘুস আদায় এবং তা আত্মসাতের অভিযোগে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।

নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অনুদান দিয়ে প্রাণ গোপাল দত্ত কুমিল্লা-৭ আসনের উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিশ্চিত করেছিলেন। ২০২১ সালের ওই উপ-নির্বাচন প্রাণ গোপাল দত্ত ওই আসন থেকে বিনা ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর প্রাণ গোপাল দত্ত নিজেই সূচনা ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত হন। সূচনা ফাউন্ডেশন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্তসহ সাতজন। পুতুল ছিলেন ফাউন্ডেশনটির চেয়ারম্যান। তবে তিনি বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরে অবস্থান করায় প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হতো ভাইস চেয়ারম্যান ডা. প্রাণ গোপাল দত্তের তত্ত্বাবধানে। যেভাবে নেওয়া হয় অনুদান মামলা এজাহার ও নথি সূত্রে জানা যায়, নানামুখী চাপে পড়ে বিভিন্ন ব্যবসায়িক গ্রুপ ও রাজনৈতিক ব্যক্তি সূচনা ফাউন্ডেশনে অর্থ দিয়েছেন। বিভিন্ন লেয়ারিংয়ের আশ্রয় নিয়ে ফাউন্ডেশনের অনূকূলে অর্থ স্থানান্তর হয়েছে। অনেকে আবার রাজনৈতিক আনুকূল্যে অনৈতিক ব্যবসায়িক সুবিধা পাওয়ার জন্য সূচনা ফাউন্ডেশনে অর্থ দেন। জানা যায়, এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে ১৪ প্রতিষ্ঠান থেকে ৫৭১ কোটি ৭৭ লাখ ২৩ হাজার ৯৪ টাকা নিয়ে তা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

সূচনা ফাউন্ডেশনে ‘বাধ্য’ হয়ে ২ কোটি টাকা অনুদান দেয় বে গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, সূচনা ফাউন্ডেশন থেকে বলা হয় অর্থ ডোনেশন দেওয়ার জন্য। একই সঙ্গে রাজস্ব বোর্ডের এসআরও ৮৭ আইন/১৬ সংক্রান্ত একটি কপি সরবরাহ করে ডোনেশন দিতে বে গ্রুপকে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করে সূচনা ফাউন্ডেশন। এরপর ওই এসআরও’র শর্ত পরিপালন সাপেক্ষে কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন চেয়ারম্যান শামসুর রহমান ডোনেশন বাবদ তিনটি পে-অর্ডারে ২ কোটি টাকা দেন। পরে ওই অর্থের হিসাব প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষা বিবরণীতে ডোনেশন অ্যান্ড সাবস্ক্রিপশন খাতে দেখিয়ে আয়কর অফিসে তা দাখিল করা হয়। চাপের মুখে ফাউন্ডেশনে অর্থ অনুদান দেয় বিলট্রেড ইঞ্জিনিয়ারিং। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ার‌ম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনায়েতুর রহমান দুদককে জানান, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার বরাবরই তাকে সরকারবিরোধী দলের ব্যবসায়ী হিসেবে দীর্ঘদিন হয়রানি করে আসছিল। এছাড়া এমপি কোটায় গাড়ি আমদানি সংক্রান্ত দুদকের এক মামলায় তিনি আসামি ছিলেন, যা আদালতে বিচারাধীন ছিল। আওয়ামী লীগের শাসনামলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে এম জয়নাল আবেদীন নামের এক ব্যক্তি তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি সূচনা ফাউন্ডেশনকে ৫ কোটি টাকা দিতে চাপ দেন। অন্যথায় তাকে কারাগারে যেতে হবে বলে হুমকি দেন জয়নাল আবেদীন। অব্যাহত হুমকি ও চাপের মুখে তিনি সূচনা ফাউন্ডেশনকে ২ কোটি টাকা প্রদান করেন। একইভাবে এক কোটি টাকা আদায় করা হয় কনফিডেন্স গ্রুপের কাছ থেকে। কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান শামসুল আলমের ওপর চাপ প্রয়োগ করে তার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে সূচনা ফাউন্ডেশনকে এক কোটি টাকা দিতে বাধ্য করা হয়। গত বছর ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর সূচনা ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। ওই বছরের ২৪ নভেম্বর সূচনা ফাউন্ডেশনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি ফাউন্ডেশনের ঠিকানায় অভিযান চালায় দুদক। পরে ফেব্রুয়ারিতে ফাউন্ডেশনের নামে থাকা আয়কর সুবিধা বাতিল করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এরপর অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার অভিপ্রায়ে সূচনা ফাউন্ডেশনে অর্থ অনুদান দেওয়া ও ফাউন্ডেশনের ৪৪৭ কোটি ৯৫ লাখ ৩০ হাজার ১৯৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আট ব্যবসায়ীসহ ৩৫ জনের নামে মামলা করে দুদক। গত ৩ সেপ্টেম্বর দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম এ মামলা করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, সূচনা ফাউন্ডেশন ১৪ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকে অনুদানের নামে ১৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা নিয়েছে। আসামিরা সূচনা ফাউন্ডেশনকে দেওয়া অর্থ এবং তাদের ব্যাংক হিসাবে থাকা অর্থ অবৈধভাবে করমুক্তির সুবিধা নিয়ে আত্মসাৎ করেন। তারা পরস্পরের যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ৪৪৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। এছাড়া ২০১৫-১৬ করবর্ষ থেকে ২০২৪-২৫ পর্যন্ত মোট ৯৯ লাখ ৪ হাজার ৫৩১ টাকা কর জমা না দিয়ে তারা প্রতারণা করেন। সূচনা ফাউন্ডেশনের নামে খোলা ১৪টি ব্যাংক হিসাবে ৯৩০ কোটি ৯৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯৫৯ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন পাওয়া গেছে। তবে তদন্তাধীন হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে চাননি আসামিরা।

মামলার আসামিরা হলেন- সূচনা ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি সায়মা ওয়াজেদ, মাজহারুল মান্নান, বিসিবির সাবেক সভাপতি ও এমপি নাজমুল হাসান পাপন, সায়ফুল্লাহ আবদুল্লাহ সোলেনখী, মো. শামসুজ্জামান, জ্যান বারী রিজভী, ভাইস চেয়ারম্যান প্রাণ গোপাল দত্ত, এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য এম এস মেহরাজ জাহান, রুহুল হক, শিরিন জামান মুনির এবং ডা. হেলালউদ্দিন আহমেদ। এছাড়া অন্য আসামিরা হলেন- হামিদ রিয়েল এস্টেটের চেয়ারম্যান ইন্তেকাবুল হামিদ, সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম, বেক্সিমকোর ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি সালমান এফ রহমান, সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. আজিজ খান, সাবেক এমপি এ কে এম রহমাতুল্লাহ, ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান মঈন উদ্দীন হাসান রশিদ, মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল এবং বিল্ড ট্রেড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও এমডি এনায়েতুর রহমান। মামলায় আসামি করা হয়েছে এনবিআরের সাবেক ও বর্তমান ১৬ কর্মকর্তাকেও। তারা হলেন- সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান, সদস্য মীর মুস্তাক আলী, চৌধুরী আমির হোসেন, পারভেজ ইকবাল, মো. ফরিদ উদ্দিন, মো. ফিরোজ শাহ আলম, জাহাঙ্গীর হোসেন, ড. মাহবুবুর রহমান, মো. লোকমান চৌধুরী, মো. রেজাউল হাসান, মো. জিয়া উদ্দিন মাহমুদ, আব্দুর রাজ্জাক, এ এফ এম শাহরিয়ার মোল্লা (আবু ফয়সাল মো. শাহরিয়ার মোল্লা), সুলতান মো. ইকবাল, তন্দ্রা সিকদার ও কালীপদ হালদার। মামলার এজাহারে আরও বলা হয়, ব্যক্তি পর্যায়ে ঘুস প্রদানকারীদের মধ্যে অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত ২০২১ সালে কুমিল্লা-৭ আসন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে সূচনা ফাউন্ডেশনকে ঘুস ও অবৈধ পারিতোষিক হিসেবে এই অর্থ দেন।

দুদকের নথি বলছে, সূচনা ফাউন্ডেশনে টাকা দিতে বিভিন্ন কোম্পানিকে চাপ দেওয়া হতো। তবে এর বিনিময়ে ওই কোম্পানি অনৈতিক বিভিন্ন সুবিধা পেতো। এভাবে অবৈধভাবে আয়ের একটি প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয় সূচনা ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশনের নামে পরিচালিত হিসাব থেকে নিয়মিত উল্লেখযোগ্য পরিমাণে নগদ অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে। তবে ওই অর্থ ফাউন্ডেশন ঘোষিত উদ্দেশ্য অর্জনে অর্থাৎ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে ব্যবহার হয়নি। গণঅভ্যুত্থানের পর বিদেশে অবস্থান বা পালিয়ে থাকায় এসব বিষয়ে অভিযুক্তদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। এসব বিষয়ে দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, ব্যবসায়ীরা ওই ফাউন্ডেশনে অনুদান দিয়ে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সূচনা ফাউন্ডেশনের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে আইন-বিধি মেনে কাজ করেছে তদন্ত দল। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা যায় কি না- সে বিষয়ে কাজ শুরু হয়েছে।

চলতি বছরের ২০ মার্চ দুর্নীতি ও প্রতারণার মাধ্যমে সূচনা ফাউন্ডেশনের জন্য ৩৩ কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহের অভিযোগে মামলা করে দুদক। এছাড়া প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পদে নিয়োগ লাভের অভিযোগে পুতুলের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করা হয়। এর আগে তথ্য গোপন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দের অভিযোগে ১২ জানুয়ারি পুতুলের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। স্বেচ্ছাসেবী ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০১৪ সালে গড়ে ওঠে সূচনা ফাউন্ডেশন। মানসিক ও স্নায়ুবিক প্রতিবন্ধিতা, অটিজম এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করার কথা জানায় প্রতিষ্ঠানটি।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

Update Time : 08:20:40 am, Thursday, 11 September 2025
38 Time View

সূচনা ফাউন্ডেশনে দানের নামে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের থেকে আদায় করতেন মোটা অঙ্কের টাকা: পুতুল

Update Time : 08:20:40 am, Thursday, 11 September 2025

বিশেষ প্রতিনিধি:
‘সূচনা ফাউন্ডেশন’ নেই অফিস, নেই কর্মী অথচ এ অস্তিত্বহীন সংস্থার দাপটে একসময় তটস্থ থাকতেন ব্যবসায়ী ও ধনাঢ্যরা। সূচনা ফাউন্ডেশন নামের ভুয়া এ সংস্থা থেকে ব্যবসায়ী ও ধনীদের সংসদ সদস্য বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে টোপ ফেলা হতো। তবে তাতে কাজ না হলে ভয়ভীতি দেখিয়ে ও চাপ প্রয়োগ করে আদায় করা হতো মোটা অঙ্কের টাকা।

এ সংস্থার চেয়ারম্যান ছিলেন গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। সূচনা ফাউন্ডেশনে অনুদান দিতে ব্যবসায়ী, চিকিৎসকসহ সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের দেওয়া হতো রাজনৈতিক চাপ, মামলার ভয় এমনকি সংসদ সদস্য বানানোর প্রলোভন। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বলছে, সূচনা ফাউন্ডেশনের কোনো অস্তিত্ব নেই। প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানায় অভিযান চালিয়ে কিছু পায়নি দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম। এরপর সূচনা ফাউন্ডেশন নামে একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান গড়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দানের নামে ঘুস আদায় এবং তা আত্মসাতের অভিযোগে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।

নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অনুদান দিয়ে প্রাণ গোপাল দত্ত কুমিল্লা-৭ আসনের উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিশ্চিত করেছিলেন। ২০২১ সালের ওই উপ-নির্বাচন প্রাণ গোপাল দত্ত ওই আসন থেকে বিনা ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর প্রাণ গোপাল দত্ত নিজেই সূচনা ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত হন। সূচনা ফাউন্ডেশন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্তসহ সাতজন। পুতুল ছিলেন ফাউন্ডেশনটির চেয়ারম্যান। তবে তিনি বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরে অবস্থান করায় প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হতো ভাইস চেয়ারম্যান ডা. প্রাণ গোপাল দত্তের তত্ত্বাবধানে। যেভাবে নেওয়া হয় অনুদান মামলা এজাহার ও নথি সূত্রে জানা যায়, নানামুখী চাপে পড়ে বিভিন্ন ব্যবসায়িক গ্রুপ ও রাজনৈতিক ব্যক্তি সূচনা ফাউন্ডেশনে অর্থ দিয়েছেন। বিভিন্ন লেয়ারিংয়ের আশ্রয় নিয়ে ফাউন্ডেশনের অনূকূলে অর্থ স্থানান্তর হয়েছে। অনেকে আবার রাজনৈতিক আনুকূল্যে অনৈতিক ব্যবসায়িক সুবিধা পাওয়ার জন্য সূচনা ফাউন্ডেশনে অর্থ দেন। জানা যায়, এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে ১৪ প্রতিষ্ঠান থেকে ৫৭১ কোটি ৭৭ লাখ ২৩ হাজার ৯৪ টাকা নিয়ে তা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

সূচনা ফাউন্ডেশনে ‘বাধ্য’ হয়ে ২ কোটি টাকা অনুদান দেয় বে গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, সূচনা ফাউন্ডেশন থেকে বলা হয় অর্থ ডোনেশন দেওয়ার জন্য। একই সঙ্গে রাজস্ব বোর্ডের এসআরও ৮৭ আইন/১৬ সংক্রান্ত একটি কপি সরবরাহ করে ডোনেশন দিতে বে গ্রুপকে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করে সূচনা ফাউন্ডেশন। এরপর ওই এসআরও’র শর্ত পরিপালন সাপেক্ষে কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন চেয়ারম্যান শামসুর রহমান ডোনেশন বাবদ তিনটি পে-অর্ডারে ২ কোটি টাকা দেন। পরে ওই অর্থের হিসাব প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষা বিবরণীতে ডোনেশন অ্যান্ড সাবস্ক্রিপশন খাতে দেখিয়ে আয়কর অফিসে তা দাখিল করা হয়। চাপের মুখে ফাউন্ডেশনে অর্থ অনুদান দেয় বিলট্রেড ইঞ্জিনিয়ারিং। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ার‌ম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনায়েতুর রহমান দুদককে জানান, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার বরাবরই তাকে সরকারবিরোধী দলের ব্যবসায়ী হিসেবে দীর্ঘদিন হয়রানি করে আসছিল। এছাড়া এমপি কোটায় গাড়ি আমদানি সংক্রান্ত দুদকের এক মামলায় তিনি আসামি ছিলেন, যা আদালতে বিচারাধীন ছিল। আওয়ামী লীগের শাসনামলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে এম জয়নাল আবেদীন নামের এক ব্যক্তি তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি সূচনা ফাউন্ডেশনকে ৫ কোটি টাকা দিতে চাপ দেন। অন্যথায় তাকে কারাগারে যেতে হবে বলে হুমকি দেন জয়নাল আবেদীন। অব্যাহত হুমকি ও চাপের মুখে তিনি সূচনা ফাউন্ডেশনকে ২ কোটি টাকা প্রদান করেন। একইভাবে এক কোটি টাকা আদায় করা হয় কনফিডেন্স গ্রুপের কাছ থেকে। কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান শামসুল আলমের ওপর চাপ প্রয়োগ করে তার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে সূচনা ফাউন্ডেশনকে এক কোটি টাকা দিতে বাধ্য করা হয়। গত বছর ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর সূচনা ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। ওই বছরের ২৪ নভেম্বর সূচনা ফাউন্ডেশনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি ফাউন্ডেশনের ঠিকানায় অভিযান চালায় দুদক। পরে ফেব্রুয়ারিতে ফাউন্ডেশনের নামে থাকা আয়কর সুবিধা বাতিল করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এরপর অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার অভিপ্রায়ে সূচনা ফাউন্ডেশনে অর্থ অনুদান দেওয়া ও ফাউন্ডেশনের ৪৪৭ কোটি ৯৫ লাখ ৩০ হাজার ১৯৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আট ব্যবসায়ীসহ ৩৫ জনের নামে মামলা করে দুদক। গত ৩ সেপ্টেম্বর দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম এ মামলা করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, সূচনা ফাউন্ডেশন ১৪ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকে অনুদানের নামে ১৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা নিয়েছে। আসামিরা সূচনা ফাউন্ডেশনকে দেওয়া অর্থ এবং তাদের ব্যাংক হিসাবে থাকা অর্থ অবৈধভাবে করমুক্তির সুবিধা নিয়ে আত্মসাৎ করেন। তারা পরস্পরের যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ৪৪৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। এছাড়া ২০১৫-১৬ করবর্ষ থেকে ২০২৪-২৫ পর্যন্ত মোট ৯৯ লাখ ৪ হাজার ৫৩১ টাকা কর জমা না দিয়ে তারা প্রতারণা করেন। সূচনা ফাউন্ডেশনের নামে খোলা ১৪টি ব্যাংক হিসাবে ৯৩০ কোটি ৯৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯৫৯ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন পাওয়া গেছে। তবে তদন্তাধীন হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে চাননি আসামিরা।

মামলার আসামিরা হলেন- সূচনা ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি সায়মা ওয়াজেদ, মাজহারুল মান্নান, বিসিবির সাবেক সভাপতি ও এমপি নাজমুল হাসান পাপন, সায়ফুল্লাহ আবদুল্লাহ সোলেনখী, মো. শামসুজ্জামান, জ্যান বারী রিজভী, ভাইস চেয়ারম্যান প্রাণ গোপাল দত্ত, এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য এম এস মেহরাজ জাহান, রুহুল হক, শিরিন জামান মুনির এবং ডা. হেলালউদ্দিন আহমেদ। এছাড়া অন্য আসামিরা হলেন- হামিদ রিয়েল এস্টেটের চেয়ারম্যান ইন্তেকাবুল হামিদ, সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম, বেক্সিমকোর ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি সালমান এফ রহমান, সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. আজিজ খান, সাবেক এমপি এ কে এম রহমাতুল্লাহ, ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান মঈন উদ্দীন হাসান রশিদ, মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল এবং বিল্ড ট্রেড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও এমডি এনায়েতুর রহমান। মামলায় আসামি করা হয়েছে এনবিআরের সাবেক ও বর্তমান ১৬ কর্মকর্তাকেও। তারা হলেন- সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান, সদস্য মীর মুস্তাক আলী, চৌধুরী আমির হোসেন, পারভেজ ইকবাল, মো. ফরিদ উদ্দিন, মো. ফিরোজ শাহ আলম, জাহাঙ্গীর হোসেন, ড. মাহবুবুর রহমান, মো. লোকমান চৌধুরী, মো. রেজাউল হাসান, মো. জিয়া উদ্দিন মাহমুদ, আব্দুর রাজ্জাক, এ এফ এম শাহরিয়ার মোল্লা (আবু ফয়সাল মো. শাহরিয়ার মোল্লা), সুলতান মো. ইকবাল, তন্দ্রা সিকদার ও কালীপদ হালদার। মামলার এজাহারে আরও বলা হয়, ব্যক্তি পর্যায়ে ঘুস প্রদানকারীদের মধ্যে অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত ২০২১ সালে কুমিল্লা-৭ আসন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে সূচনা ফাউন্ডেশনকে ঘুস ও অবৈধ পারিতোষিক হিসেবে এই অর্থ দেন।

দুদকের নথি বলছে, সূচনা ফাউন্ডেশনে টাকা দিতে বিভিন্ন কোম্পানিকে চাপ দেওয়া হতো। তবে এর বিনিময়ে ওই কোম্পানি অনৈতিক বিভিন্ন সুবিধা পেতো। এভাবে অবৈধভাবে আয়ের একটি প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয় সূচনা ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশনের নামে পরিচালিত হিসাব থেকে নিয়মিত উল্লেখযোগ্য পরিমাণে নগদ অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে। তবে ওই অর্থ ফাউন্ডেশন ঘোষিত উদ্দেশ্য অর্জনে অর্থাৎ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে ব্যবহার হয়নি। গণঅভ্যুত্থানের পর বিদেশে অবস্থান বা পালিয়ে থাকায় এসব বিষয়ে অভিযুক্তদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। এসব বিষয়ে দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, ব্যবসায়ীরা ওই ফাউন্ডেশনে অনুদান দিয়ে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সূচনা ফাউন্ডেশনের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে আইন-বিধি মেনে কাজ করেছে তদন্ত দল। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা যায় কি না- সে বিষয়ে কাজ শুরু হয়েছে।

চলতি বছরের ২০ মার্চ দুর্নীতি ও প্রতারণার মাধ্যমে সূচনা ফাউন্ডেশনের জন্য ৩৩ কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহের অভিযোগে মামলা করে দুদক। এছাড়া প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পদে নিয়োগ লাভের অভিযোগে পুতুলের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করা হয়। এর আগে তথ্য গোপন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দের অভিযোগে ১২ জানুয়ারি পুতুলের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। স্বেচ্ছাসেবী ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০১৪ সালে গড়ে ওঠে সূচনা ফাউন্ডেশন। মানসিক ও স্নায়ুবিক প্রতিবন্ধিতা, অটিজম এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করার কথা জানায় প্রতিষ্ঠানটি।