মতিঝিলে চাঁদাবাজির শূন্যস্থান দখল করলেন কারা?

স্টাফ রিপোর্টার:
রাজধানী ঢাকার মোটামুটি সব সড়কের পাশেই আছে ফুটপাত! তবে কোনো সরকারের আমলেই হেঁটে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি রাজধানীবাসী। হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে ঢাকার ফুটপাতের ‘চাবি’ ছিল আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে। সেখানকার অবৈধ দোকানের ভাড়ার টাকা গুনতেন সরকারদলীয় নেতারা। এমনকি টাকার ভাগ যেত পুলিশের পকেটেও। শক্তি হারিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা যে যার মতো পালালেও ফুটপাতজুড়ে এখনও আছে সারি সারি দোকান, আছে নানা স্থাপনা। তবে এখনকার দখলবাজ কারা? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি আমরা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানী ঢাকার ফুটপাতে দখল, চাঁদাবাজি, উৎপাত– সবই আছে আগের মতো। শুধু বদলেছে কুশীলব। বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধেই মিলেছে বেশির ভাগ দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগ। তবে বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে দখল চাঁদাবাজির বিষয়ে নেওয়া হয়েছে শূন্য সহনশীল নীতি। এসব অপকর্মে জড়িত থাকলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে কয়েকজন স্থানীয় নেতাকে বহিষ্কারও করেছে দলটি। তবু অনেক এলাকায় ফুটপাত দখল চাঁদাবাজিতে জড়িয়েছেন বিএনপির নেতাকর্মী। রাজধানীর প্রায় সব এলাকায় ফুটপাতের দখল ও নিয়ন্ত্রণ হাতবদল হয়েছে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আগের মতো ফুটপাত ও সড়ক দখল হয়ে যাওয়ায় অনেক এলাকাতেই মানুষের চলার পথ সংকুচিত হয়ে বেড়েছে যানজট। কোথাও অবৈধ স্থাপনা, আবার কোথাও বিভিন্ন মালপত্র রাখার কারণে অনর্থক কষ্টে পড়ছেন পথচারী। ফুটপাতে জায়গা না পেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সড়কে নেমে হাঁটতে হচ্ছে নগরবাসীকে। তবে ফুটপাত দখলমুক্ত করার ব্যাপারে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের যেমন দৃষ্টিপাত নেই, তেমনি চাঁদাবাজি বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও নেই হেলদোল।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার ফুটপাতের দৈর্ঘ্য ৪৩০ কিলোমিটার। সেখানে অন্তত তিন লাখ হকার ব্যবসা করেন। প্রভাবশালীরা তাদের কাছে থেকে বছরে চাঁদা তোলে ২ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। ফুটপাত কেন্দ্রিক চাঁদাবাজির টাকা যায় পুলিশ, রাজনৈতিক ব্যক্তি আর লাইনম্যানের পকেটে।
মতিঝিলে চলে ভিন্ন রূপে চাঁদাবাজি;
দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতারা বিএনপি ও যুবদলের নেতাদের মাধ্যমে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়- গত ৫ আগস্ট এর পর আত্মগোপনে থাকা মতিঝিল থানা যুবলীগের নেতা নুরুল ইসলাম চৌধুরী নূরু গ্রেফতারের ভয়ে পালিয়ে গেলেও তিনি এখন মতিঝিল যুবদলের নেতা মমিন বেপারীর ছত্রছায়ায় বিভিন্ন সময়ে ছদ্মবেশে মতিঝিল এসে চালিয়ে যাচ্ছে পুনরায় চাঁদাবাজির মূল কার্যক্রম।
সূত্রে জানা যায়, মতিঝিল এলাকার চাঁদাবাজির হাত বদল করে যুবলীগ নেতা নুরুর সব অবৈধ কার্যক্রম প্রকাশ্যে নিয়ন্ত্রণ করছে বিএনপির অঙ্গসংগঠন মতিঝিল থানা যুবদলের নেতা মমিন বেপারী। এবং নুরুল ইসলাম চৌধুরী নূরুর চাঁদাবাজির স্থানগুলো বুঝে নিয়েছেন মমিন বেপারী গং। যুবলীগ নেতা নুরুল ইসলাম চৌধুরী নূরুর হাতে গড়া মাদক ব্যবসায়ী মনি-মুক্তা এখনো ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এসব মাদক ব্যবসার মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে সেল্টার দিচ্ছেন যুবদলের নেতা মমিন বেপারী, সাবেক সদস্য সচিব ফজলুল হক ফজলু, রনি মোল্লা, যুবদল নেতা খোকন।
মতিঝিল ক্লাবপাড়া মাদকও বিভিন্ন প্রেস থেকে মাশোআরা আদায় করে যাচ্ছে এই যুবদল নেতারাই।
বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত অভিযোগে মতিঝিল থানা যুবদল সদস্য সচিব ফারুক মাহামুদ, মতিঝিল থানা যুবদলের সাবেক সদস্য সচিব ফজলুল হক ফজলু, মতিঝিল থানার যুবদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক রনি মোল্লা খোকন, ৯নং ওয়ার্ড যুবদলের আহবায়ক মমিন বেপারী, ৯নং ওয়ার্ড যুবদলের সদস্য সচিব বিপ্লব হোসেন মিতুর বিরুদ্ধে মতিঝিল এলাকায় চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। কেউ প্রতিবাদ করলে মোটরসাইকেল মহড়া দিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন তারা।
মতিঝিল এলাকার ফুটপাতের একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফুটপাতে দোকানের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। স্থানীয় বিএনপির কর্মীরা নতুন করে শার্ট-গেঞ্জিসহ বিভিন্ন সামগ্রীর দোকান বসিয়েছেন। তবে দোকানের মালিকের বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি। শাপলা চত্বর এলাকার ফুটপাতের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তাঁর দোকানের সামনে শার্টের নতুন কয়েকটি দোকান বসেছে। ওই দোকান গুলোর শার্ট বিক্রেতার কাছে দোকানের মালিক বিষয়ে জানতে চাইলে তারা ভয়ে নাম বলতে রাজি হননি। মতিঝিল পূবালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় গেঞ্জি বিক্রেতা আবুল বাশার জানান, তিনি ৩০ বছর ধরে মতিঝিল এলাকায় ব্যবসা করছেন। আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি চাঁদা দিতে হচ্ছে।
এই চাঁদাবাজির বিষয়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বিএনপি জনগণের রাজনীতি করে। এখানে দুর্বৃত্তের কোনো স্থান নেই। দলের নাম ভাঙিয়ে যারাই অপকর্মের চেষ্টা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে এর মধ্যে বেশির ভাগই ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগের দোসর। যারা বিএনপির রূপ ধারণ করে কৌশলে ষড়যন্ত্র করছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী মীর খাইরুল আলম বলেন, ফুটপাত ব্যবসায়ীদের পেছনে অনেক বড় শক্তি থাকে। তবে সরকার বদলের পর এটা অনেকটাই কমে গেছে। এখন ফুটপাত দখলমুক্তের চেষ্টা করছি। নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত বসানো হয়। তবে এখন পুলিশ সেভাবে পাওয়া না যাওয়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালত কার্যকর কম হচ্ছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী বলেন, যারা ফুটপাতে ব্যবসা করছে, তারা আইনকানুন মানতে চাচ্ছে না।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, চাঁদাবাজদের কোনো দল নেই। চাঁদাবাজির ব্যাপারে আমরা সব সময় সজাগ। বিভিন্ন সময় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবু বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকেই সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) ফারুক হোসেন বলেন, ফুটপাতের স্থাপনা আমরা পর্যায়ক্রমে সরিয়ে দিচ্ছি। মানুষ যাতে চলাচলে বাধা না পায়, সে জন্য এই কার্যক্রম আরও জোরদার করা হবে।
(বিস্তারিত আসছে দ্বিতীয় পর্বে)
																			
																		
								                                        

















