10:30 pm, Tuesday, 4 November 2025

মব সহিংসতা ও গণপিটুনিতে ১৪ মাসে নিহত ২১৬

দিগন্ত প্রতিদিন

1761951270 4aaa6c0dbbfad5d753b09ab95b1e22b5

 

বিশেষ প্রতিনিধি:
‘আমার পোলা তো চোর আছিল না, রাস্তা থাইক্যা ধইরা ওরা পোলাডারে পিডাইয়া মারছে। আমি এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।’ এভাবেই করুণ আর্তির সুরে কথা বলছিলেন সন্তান আনোয়ারকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়া মা দিলরুবা আক্তার। গত শুক্রবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে বিআইডব্লিউটিএর ইলেকট্রিশিয়ান আনোয়ার হোসেন বাবুকে হাত-পা বেঁধে রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে একদল লোক।

প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, নিহত বাবু চোর ছিলেন না। কিন্তু তাঁকে ‘চোর’ সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ‘চোর’ প্রচারণা চালিয়ে বা সন্দেহের বশে বা অপরাধী সাব্যস্ত করার পর আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে গত অক্টোবর পর্যন্ত ১৪ মাসে গণপিটুনিতে কমপক্ষে ২১৬ ব্যক্তিকে এভাবে জীবন দিতে হয়েছে। একই সময়ে গণপিটুনিতে আহত ২৭৫ জন।

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) ও মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) এসংক্রান্ত মাসিক পরিসংখ্যানে এই তথ্যচিত্র উঠে এসেছে।

এইচআরএসএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৩ মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনিতে ২০৪ জন নিহত হয়। এমএসএফ বলছে, শুধু গত অক্টোবরে গণপিটুনিতে ১২ জন নিহত হয়। এই হিসাবে গত ১৪ মাসে গণপিটুনিতে দেশে ২১৬ জন নিহত হয়েছে।

জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, ‘দেশে মব ভায়োলেন্স নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। আমরা চেষ্টা করছি কিভাবে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে সমাজে শান্তি ফেরানো যায়। তবে পুলিশের একার পক্ষে মব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এ ক্ষেত্রে সবার সম্মিলিত প্রয়াস দরকার।’

পুলিশের ওপরও মব ভায়োলেন্স হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘যারা পুলিশের কাজে বাধা সৃষ্টি করছে তাদেরও গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।’ এদিকে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) পুলিশের ওপর মব সন্ত্রাস, হামলা, হেনস্তার ঘটনায় ৪৬২টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭০টি ছিল বড় ধরনের হামলার ঘটনা।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা বলেন, ‘মব সন্ত্রাস বেড়েছে। তবে একজন নিরপরাধ মানুষকে পিটিয়ে হত্যা আইনের দৃষ্টিতে চরম অপরাধ। যারা এভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে এ ধরনের ঘটনা বাড়তেই থাকবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, গণপিটুনি কিন্তু মবের একটি অংশ। মবের তো অনেক ধর্ম আছে, তার মধ্যে গণপিটুনি কিন্তু রয়েছে। এখন আমরা এ কথাটাই শুরু থেকে বলছি যে গণপিটুনি বলুন অথবা পরিকল্পিতভাবে কাউকে আক্রমণ বলুন অথবা আকস্মিক কোনো পরিবেশ বা সংকটে কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলা বা আহত করা, রক্তাক্ত করা—এই কাজগুলোকে কোনোভাবেই বৈধতা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

কারণ নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু আসলে এই মবের প্রসঙ্গ, গণপিটুনির প্রসঙ্গকে রাজনৈতিকভাবে কখনো কখনো ইনিয়ে-বিনিয়ে সহনশীল করার চেষ্টা করা হয়েছে। আবার এটাকে জায়েজ করারও চেষ্টা হয়েছে। এই সুযোগে এভাবে যারা ক্ষোভ প্রশমিত করতে চায় এবং পুরনো শত্রুতা আছে যেটা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অথবা ব্যক্তিগত কোনো সম্পর্কগত বিরোধের প্রেক্ষাপটে হোক, ব্যবসা-বাণিজ্য বা আর্থিক লেনদেন হোক, রাজনৈতিক কোনো পদ-পদবি, অবস্থানের প্রেক্ষাপটে হোক—যে প্রেক্ষাপটেই হোক সেটি সমাধান করার জন্য আইন আছে। কারো বিরুদ্ধে কারো ক্ষোভ থাকলে সেটি আইনগতভাবে সুরাহা হবে।

এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত হলো এ ধরনের অভিযোগগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করা এবং এক ধরনের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার পক্ষে কথা বলার জন্য রাষ্ট্র আছে, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো আছে এবং কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার দল ক্ষমতায় আসা বা ক্ষমতার কাছাকাছি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না—এই পরিবেশ-পরিস্থিতি আমরা এখনো পর্যন্ত তৈরি করতে পারিনি। সুতরাং গণপিটুনি, মব, আকস্মিক বা পরিকল্পিত আক্রমণ বা কাউকে সম্মানহানি করা—এগুলোকে কোনো না কোনোভাবে হোক, বুঝে হোক বা না বুঝে হোক, শত্রুতা থেকে হোক, পূর্বক্ষোভ বা প্রতিশোধ নেওয়া থেকে হোক—সমাজের মধ্যে এর একটা বৈধকরণ চলছে। এই বৈধকরণ বন্ধ এবং যারা অভিযুক্ত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এটা সমাধান করতে হবে। এখানে গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে যখন গণপিটুনি, মবের প্রসঙ্গগুলো তৈরি হলো তখন এ প্রসঙ্গে যারা ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, তাদের এক ধরনের নীরবতা আমরা লক্ষ করলাম এবং অপরাধীরা বা যারা ক্ষোভ প্রশমিত করতে চায় তারা মূলত দেখে যে আসলে এ প্রসঙ্গে যারা দায়িত্ব পালন করবে বা যারা এটাকে প্রতিরোধ করবে তারা বিষয়টিকে কিভাবে দেখছে। তারা কিভাবে দেখছে সেই বাস্তবতা হলো এটাকে সহনশীল বা নমনীয় করার বা এর সামাজিক প্রয়োজন আছে—এমন একটা প্রসঙ্গ বা একটা আলোচনা বা একটা বয়ান তৈরি হলো। তার সূত্র ধরে এই গণপিটুনি অথবা মব সৃষ্টি করে।’

এইচআরএসএসের নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম বলেন, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৩ মাসে দেশে মব সন্ত্রাস, সহিংসতা, মব সহিংসতা, গণপিটুনিতে নির্যাতন ও হত্যা, নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণ, মাজারে হামলা ও ভাঙচুর এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলা বেড়েছে। চাঁদাবাজি, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, হত্যাসহ বেশ কিছু সামাজিক অপরাধ ঘটেছে, যা জনমনে ভয় ও আতঙ্ক তৈরি করেছে।

সাম্প্রতিক উল্লেখযোগ্য ঘটনা: সর্বশেষ গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার নাসিরাবাদ গ্রামে চোর সন্দেহে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এর আগে গত গত শুক্রবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে হাত-পা বেঁধে রড দিয়ে পিটিয়ে বিআইডব্লিউটিএর বিদ্যুিমস্ত্রি আনোয়ার হোসেন বাবুকে পিটিয়ে হত্যা করে একদল লোক। নিহত আনোয়ার হোসেন স্ত্রী ও দুই মেয়ে নিয়ে রাজধানীর মাতুয়াইলের মৃধাবাড়িতে থাকতেন। আনোয়ারের ভাই মো. দেলোয়ার বলেন, ‘ওরা আমার ভাইকে চোর সন্দেহে পিটিয়ে মেরেছে। অথচ আমার ভাই একজন বিদ্যুিমস্ত্রি ছিল। কাজ করে সংসার চালাত। এখন ভাইয়ের দুই মেয়ে ও স্ত্রী কিভাবে চলবে?’ ঘটনার পর যাত্রাবাড়ী থানার ওসি মো. কামরুজ্জামান তালুকদার বলেন, এই যুবককে চোর সন্দেহে যারা পিটিয়ে হত্যা করেছে তারা অপরাধী। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

তিনি বলেন, কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে তাকে ধরে পুলিশের হাতে সোপর্দ করার কথা। একই দিন দুপুরে রাজধানীর তুরাগের রানাভোলায় নিরপত্তাকর্মী আব্দুল মান্নান নিহত হওয়ার ঘটনায় এক কিশোর চালককে গণপিটুনি দেয় স্থানীয়রা। এর আগের দিন গত ৩০ অক্টোবর ভোলার বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল কলেজে সহকর্মীরা পিটিয়ে আহত করেন সেলিম আহমেদ লিটন নামের এক শিক্ষককে। এভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘মব সন্ত্রাস’ আরো বেড়েছে। এতে দেশের সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। ভুক্তভোগীরা আছে আতঙ্কে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। এ অবস্থায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকারকর্মীরা। সরকারের উপদেষ্টারা কয়েক মাস ধরে মব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

কিছুদিন আগে ডিএমপি সদর দপ্তরে এক অনুষ্ঠানে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছিলেন, ‘মব সন্ত্রাস ঠেকাতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

Update Time : 11:35:14 pm, Monday, 3 November 2025
48 Time View

মব সহিংসতা ও গণপিটুনিতে ১৪ মাসে নিহত ২১৬

Update Time : 11:35:14 pm, Monday, 3 November 2025

 

বিশেষ প্রতিনিধি:
‘আমার পোলা তো চোর আছিল না, রাস্তা থাইক্যা ধইরা ওরা পোলাডারে পিডাইয়া মারছে। আমি এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।’ এভাবেই করুণ আর্তির সুরে কথা বলছিলেন সন্তান আনোয়ারকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়া মা দিলরুবা আক্তার। গত শুক্রবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে বিআইডব্লিউটিএর ইলেকট্রিশিয়ান আনোয়ার হোসেন বাবুকে হাত-পা বেঁধে রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে একদল লোক।

প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, নিহত বাবু চোর ছিলেন না। কিন্তু তাঁকে ‘চোর’ সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ‘চোর’ প্রচারণা চালিয়ে বা সন্দেহের বশে বা অপরাধী সাব্যস্ত করার পর আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে গত অক্টোবর পর্যন্ত ১৪ মাসে গণপিটুনিতে কমপক্ষে ২১৬ ব্যক্তিকে এভাবে জীবন দিতে হয়েছে। একই সময়ে গণপিটুনিতে আহত ২৭৫ জন।

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) ও মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) এসংক্রান্ত মাসিক পরিসংখ্যানে এই তথ্যচিত্র উঠে এসেছে।

এইচআরএসএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৩ মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনিতে ২০৪ জন নিহত হয়। এমএসএফ বলছে, শুধু গত অক্টোবরে গণপিটুনিতে ১২ জন নিহত হয়। এই হিসাবে গত ১৪ মাসে গণপিটুনিতে দেশে ২১৬ জন নিহত হয়েছে।

জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, ‘দেশে মব ভায়োলেন্স নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। আমরা চেষ্টা করছি কিভাবে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে সমাজে শান্তি ফেরানো যায়। তবে পুলিশের একার পক্ষে মব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এ ক্ষেত্রে সবার সম্মিলিত প্রয়াস দরকার।’

পুলিশের ওপরও মব ভায়োলেন্স হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘যারা পুলিশের কাজে বাধা সৃষ্টি করছে তাদেরও গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।’ এদিকে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) পুলিশের ওপর মব সন্ত্রাস, হামলা, হেনস্তার ঘটনায় ৪৬২টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭০টি ছিল বড় ধরনের হামলার ঘটনা।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা বলেন, ‘মব সন্ত্রাস বেড়েছে। তবে একজন নিরপরাধ মানুষকে পিটিয়ে হত্যা আইনের দৃষ্টিতে চরম অপরাধ। যারা এভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে এ ধরনের ঘটনা বাড়তেই থাকবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, গণপিটুনি কিন্তু মবের একটি অংশ। মবের তো অনেক ধর্ম আছে, তার মধ্যে গণপিটুনি কিন্তু রয়েছে। এখন আমরা এ কথাটাই শুরু থেকে বলছি যে গণপিটুনি বলুন অথবা পরিকল্পিতভাবে কাউকে আক্রমণ বলুন অথবা আকস্মিক কোনো পরিবেশ বা সংকটে কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলা বা আহত করা, রক্তাক্ত করা—এই কাজগুলোকে কোনোভাবেই বৈধতা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

কারণ নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু আসলে এই মবের প্রসঙ্গ, গণপিটুনির প্রসঙ্গকে রাজনৈতিকভাবে কখনো কখনো ইনিয়ে-বিনিয়ে সহনশীল করার চেষ্টা করা হয়েছে। আবার এটাকে জায়েজ করারও চেষ্টা হয়েছে। এই সুযোগে এভাবে যারা ক্ষোভ প্রশমিত করতে চায় এবং পুরনো শত্রুতা আছে যেটা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অথবা ব্যক্তিগত কোনো সম্পর্কগত বিরোধের প্রেক্ষাপটে হোক, ব্যবসা-বাণিজ্য বা আর্থিক লেনদেন হোক, রাজনৈতিক কোনো পদ-পদবি, অবস্থানের প্রেক্ষাপটে হোক—যে প্রেক্ষাপটেই হোক সেটি সমাধান করার জন্য আইন আছে। কারো বিরুদ্ধে কারো ক্ষোভ থাকলে সেটি আইনগতভাবে সুরাহা হবে।

এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত হলো এ ধরনের অভিযোগগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করা এবং এক ধরনের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার পক্ষে কথা বলার জন্য রাষ্ট্র আছে, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো আছে এবং কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার দল ক্ষমতায় আসা বা ক্ষমতার কাছাকাছি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না—এই পরিবেশ-পরিস্থিতি আমরা এখনো পর্যন্ত তৈরি করতে পারিনি। সুতরাং গণপিটুনি, মব, আকস্মিক বা পরিকল্পিত আক্রমণ বা কাউকে সম্মানহানি করা—এগুলোকে কোনো না কোনোভাবে হোক, বুঝে হোক বা না বুঝে হোক, শত্রুতা থেকে হোক, পূর্বক্ষোভ বা প্রতিশোধ নেওয়া থেকে হোক—সমাজের মধ্যে এর একটা বৈধকরণ চলছে। এই বৈধকরণ বন্ধ এবং যারা অভিযুক্ত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এটা সমাধান করতে হবে। এখানে গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে যখন গণপিটুনি, মবের প্রসঙ্গগুলো তৈরি হলো তখন এ প্রসঙ্গে যারা ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, তাদের এক ধরনের নীরবতা আমরা লক্ষ করলাম এবং অপরাধীরা বা যারা ক্ষোভ প্রশমিত করতে চায় তারা মূলত দেখে যে আসলে এ প্রসঙ্গে যারা দায়িত্ব পালন করবে বা যারা এটাকে প্রতিরোধ করবে তারা বিষয়টিকে কিভাবে দেখছে। তারা কিভাবে দেখছে সেই বাস্তবতা হলো এটাকে সহনশীল বা নমনীয় করার বা এর সামাজিক প্রয়োজন আছে—এমন একটা প্রসঙ্গ বা একটা আলোচনা বা একটা বয়ান তৈরি হলো। তার সূত্র ধরে এই গণপিটুনি অথবা মব সৃষ্টি করে।’

এইচআরএসএসের নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম বলেন, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৩ মাসে দেশে মব সন্ত্রাস, সহিংসতা, মব সহিংসতা, গণপিটুনিতে নির্যাতন ও হত্যা, নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণ, মাজারে হামলা ও ভাঙচুর এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলা বেড়েছে। চাঁদাবাজি, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, হত্যাসহ বেশ কিছু সামাজিক অপরাধ ঘটেছে, যা জনমনে ভয় ও আতঙ্ক তৈরি করেছে।

সাম্প্রতিক উল্লেখযোগ্য ঘটনা: সর্বশেষ গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার নাসিরাবাদ গ্রামে চোর সন্দেহে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এর আগে গত গত শুক্রবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে হাত-পা বেঁধে রড দিয়ে পিটিয়ে বিআইডব্লিউটিএর বিদ্যুিমস্ত্রি আনোয়ার হোসেন বাবুকে পিটিয়ে হত্যা করে একদল লোক। নিহত আনোয়ার হোসেন স্ত্রী ও দুই মেয়ে নিয়ে রাজধানীর মাতুয়াইলের মৃধাবাড়িতে থাকতেন। আনোয়ারের ভাই মো. দেলোয়ার বলেন, ‘ওরা আমার ভাইকে চোর সন্দেহে পিটিয়ে মেরেছে। অথচ আমার ভাই একজন বিদ্যুিমস্ত্রি ছিল। কাজ করে সংসার চালাত। এখন ভাইয়ের দুই মেয়ে ও স্ত্রী কিভাবে চলবে?’ ঘটনার পর যাত্রাবাড়ী থানার ওসি মো. কামরুজ্জামান তালুকদার বলেন, এই যুবককে চোর সন্দেহে যারা পিটিয়ে হত্যা করেছে তারা অপরাধী। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

তিনি বলেন, কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে তাকে ধরে পুলিশের হাতে সোপর্দ করার কথা। একই দিন দুপুরে রাজধানীর তুরাগের রানাভোলায় নিরপত্তাকর্মী আব্দুল মান্নান নিহত হওয়ার ঘটনায় এক কিশোর চালককে গণপিটুনি দেয় স্থানীয়রা। এর আগের দিন গত ৩০ অক্টোবর ভোলার বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল কলেজে সহকর্মীরা পিটিয়ে আহত করেন সেলিম আহমেদ লিটন নামের এক শিক্ষককে। এভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘মব সন্ত্রাস’ আরো বেড়েছে। এতে দেশের সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। ভুক্তভোগীরা আছে আতঙ্কে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। এ অবস্থায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকারকর্মীরা। সরকারের উপদেষ্টারা কয়েক মাস ধরে মব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

কিছুদিন আগে ডিএমপি সদর দপ্তরে এক অনুষ্ঠানে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছিলেন, ‘মব সন্ত্রাস ঠেকাতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।