চাঁদাবাজি, ঘুষ, হয়রানি আর মাসোহারা বাণিজ্যের আলোচনায়- ‘ওসি হান্নান এখন টাকার কুমির

বিশেষ প্রতিনিধি:
যেন সরকারি দায়িত্ব নয়, বরং পেয়েছেন ‘আলাদিনের চেরাগ’। তিনি হলেন আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, (ওসি) আব্দুল হান্নান। যোগদানের কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি থানার একচ্ছত্র শাসক হয়ে ওঠেন। ভয় দেখানো, হয়রানি, মাদক ব্যবসায়ী থেকে মাসোহারা আদায়- কোনো কাণ্ডই বাদ যায়নি তাঁর খাতায়। স্থানীয়দের অভিযোগ, থানাকে তিনি পরিণত করেছেন ব্যক্তিগত রাজ্যে, আর নিজেকে বানিয়েছেন স্থানীয় রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও অপরাধীদের সঙ্গে অর্থ লেনদেনের প্রধান মধ্যস্থতাকারী হিসেবে। যদিও এসব বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ ওসি হান্নান।
সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ জুন আশুলিয়া থানায় যোগ দেন ওসি হান্নান। প্রথম দিকে তিনি ছিলেন বিনয়ী ও হাস্যোজ্জ্বল; দোকানদার থেকে কনস্টেবল- সবাইকে সালাম দিতেন নিজে। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই বদলে যায় চেহারা। এখন তাঁর মুখে হাসি নেই, আছে কড়া হুকুম, হুমকি আর টাকার গন্ধ। থানার ভেতর থেকে শুরু করে আশুলিয়ার অলিগলি পর্যন্ত এখন আলোচনায়- ‘ওসি হান্নান টাকার কুমির।’
থানার অভ্যন্তরীণ একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই শুরু হয় ওসি হান্নানের ব্যক্তিগত অর্থবাণিজ্যের ‘বিশেষ অধ্যায়’। বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের কাছ থেকে নেওয়া হতো মোটা অঙ্কের টাকা। থানার কোনো কর্মকর্তা যদি ওসিকে না জানিয়ে কোনো আসামিকে ধরে আনতেন, তাঁদের সঙ্গে ব্যবহার করা হতো অশালীন ভাষা ও হুমকি।
রিয়াজ নামের একজন ভুক্তভোগী বলেন, ‘সম্প্রতি আমার এক বন্ধুকে থানায় ধরে আনা হয়। আমি বন্ধুর খোঁজ নিতে গেলে ওসি স্যারকে জিজ্ঞেস করি- স্যার, আমার বন্ধুর অপরাধ কী? এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি আমাকে গালিগালাজ করে আমাকে বৈষম্যবিরোধী মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখান। একপর্যায়ে হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে ফোনের গ্যালারি ঘেঁটে দেখেন এবং বলেন, ‘তুই আওয়ামী লীগ করিস, তোকে ওর সঙ্গেই চালান দেব।’ আমি কোনো রকমে সেখান থেকে পালিয়ে আসি।’
রিয়াজ আরও জানান, এরপর থেকে ওসি তাঁর বাড়িতে লোক পাঠিয়ে বিভিন্নভাবে হয়রানি করার চেষ্টা করেন। এই ঘটনার পর তিনি পুলিশ সদর দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে সাভার সার্কেলের এক অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে বিষয়টি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন।
আশুলিয়া জাতীয় স্মৃতিসৌধ ফাঁড়ির এক সাবেক পুলিশ সদস্য বলেন, ‘ওসি আব্দুল হান্নান একজন খারাপ প্রকৃতির লোক। উপর-উপর মিষ্টি কথা বললেও অন্তরে বিষ। নিরিবিলি এলাকার কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী ছোট বিল্লালকে ধরতে গেলে তিনি আমাদের ডেকে নেন, গালিগালাজ করেন, পরদিনই আমাদের বদলি করে দেন।’ তাঁর দাবি, ছোট বিল্লালের কাছ থেকে প্রতি মাসে এক লাখ টাকা করে মাসোহারা নেন ওসি আব্দুল হান্নান। বিল্লালের সহযোগী রানা সেই টাকা ওসির হাতে পৌঁছে দেয়।
পুলিশের এই সদস্য আফসোস করে বলেন, ‘আমি যেদিন ওসি স্যারকে সামনে পাব সেদিন তার কাছে জানতে চাব, স্যার আমার অপরাধ কী?’ তিনি শুধু আমাকে না, আমার সঙ্গের সবাইকে চাঁদাবাজ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বদলি করে দেন।
অভিযোগ রয়েছে, আশুলিয়ার বগাবাড়ীর একটি জুয়ার আসর থেকেও ওসি হান্নান তাঁর বডিগার্ডের মাধ্যমে নিয়মিত দেড় লাখ টাকা মাসোহারা নেন। আর থানার অভ্যন্তরে ঘুষের টাকা সংগ্রহ ও হিসাব তদারকি করেন তাঁর ঘনিষ্ঠজন আব্দুল হামিদ।
অন্যদিকে ইব্রাহিম নামের চাড়ালপাড়া গ্রামের এক বাসিন্দার অভিযোগ, বাইপাইল এলাকায় তাঁর একটি আড়ৎ রয়েছে। মালিকের কাছ থেকে পাওয়ার নিয়ে ব্যবসা চালাতেন। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষের প্রভাবে ওসি তাঁর বাড়িতে রাত তিনটায় পুলিশ পাঠান, হয়রানি করেন। বলেন, ‘আমার নামে নাকি মার্ডার মামলা আছে, এই ভয় দেখিয়ে অন্য গ্রুপের হয়ে ওসি টাকা খেয়ে কাজ করছেন। এখন আমি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।’
স্থানীয় রাজনৈতিক মহলেও ওসির বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছে। অভিযোগ উঠেছে, তিনি আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে গোপনে বৈঠক করে থানার কার্যক্রমে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ দেন। একইসঙ্গে বিএনপি ও অন্যান্য দলের নেতাদের ঘুষ ও ভয় দেখিয়ে মামলা দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
বিএনপির এক নেতা বলেন, ‘আমাদের একটি বৈধ জায়গা নিয়ে সমস্যা হয়েছিল। কাজটি সমাধানের জন্য নিজের হাতে ওসিকে টাকা দিয়ে আসলাম।’
ধামসোনা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ডা. আসাদুল্লাহ দুলাল বলেন, ‘আমার বৈধ জমির ওপর ভূমিদস্যু মতিনের দখল নিয়ে থানায় অভিযোগ করলে উল্টো ওসি মতিনের কাছ থেকে টাকা খেয়ে আমার নামে পাঁচটি মামলা দেন। কোনো তদন্ত ছাড়াই আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন। এমন পুলিশ কর্মকর্তা দেশ ও সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে ওসি আব্দুল হান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে ফোনে প্রতিবেদককে বলেন, ‘আপনি সামনে আসেন, তারপর কথা বলব।’ পরবর্তীতে থানায় গিয়ে সরাসরি কথা বলতে চাইলে এ বিষয়ে মুখ খোলার বদলে তিনি দায় ঢালেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ওপর, বলেন, ‘আমি কোনো কথা বলব না, যা বলার আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলবেন।’
অনেকেই বলছেন, জনগণের বন্ধু হিসেবে পুলিশের দায়িত্ব যখন আস্থাহীনতায় পরিণত হয়, তখন সাধারণ মানুষ কার কাছে ন্যায়বিচার চাইবে? এভাবে আশুলিয়া থানার এই ওসিকে ঘিরে একের পর এক অভিযোগের ফলে এখন পুরো সাভার জুড়েই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু তিনি।
																			
																		
								                                        

















