শাহাদাতবার্ষিকীতে সরকারের নানা কর্মসূচি: আধিপত্যবাদ বিরোধী ঐক্যের প্রতীক শহীদ আবরার ফাহাদ

স্টাফ রিপোর্টার:
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদকে ২০১৯ সালের আজকের এইদিনে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এ হত্যাকাণ্ড কেবল একটি ছাত্রহত্যার ঘটনা ছিল না, এটি ছিল ভিন্নমত দমন, ফ্যাসিবাদী নিপীড়ন এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেওয়ার নৃশংস প্রচেষ্টা। শহীদ আবরার ফাহাদের সে আত্মত্যাগ পরবর্তী সময়ে দেশজুড়ে আধিপত্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনের এক অবিস্মরণীয় প্রতীকে পরিণত হয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের (১৭তম ব্যাচ) মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরেবাংলা হলের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন। এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ছিল বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তৎকালীন কিছু চুক্তির সমালোচনা করে ফেসবুকে দেওয়া তার একটি স্ট্যাটাস।
আবরার ফাহাদ সেদিনই কুষ্টিয়ার গ্রামের বাড়ি থেকে বুয়েট হলে ফিরেছিলেন। সন্ধ্যা ৮টার দিকে তাকে শেরেবাংলা হলের দোতলার ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে পাঠায় তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুসারে, তার মোবাইল ফোন ঘেঁটে ফেসবুক ও মেসেঞ্জারে ভারতবিরোধী স্ট্যাটাস ও মতাদর্শের প্রমাণ পাওয়ার পর ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে পেটাতে শুরু করে তারা। পরে চতুর্থ বর্ষের কয়েকজন নেতাকর্মী এসে আরেক দফা নির্যাতন চালায় তার ওপর।
রাতভর পৈশাচিক নির্যাতনে একপর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে পড়েন আবরার । হত্যাকারীরা তার নিথর দেহ সিঁড়িতে ফেলে রেখে রাতের খাবার খেতে যায়। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর আবরারের লাশ সিঁড়ি থেকে হলের ক্যান্টিনে নিয়ে রাখা হয় এবং ভোরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠানো হয়। হলের সিসিটিভি ফুটেজে আবরারকে কয়েকজনের ধরাধরি করে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখা যায়।
সে সময় হল প্রাধ্যক্ষ জাফর ইকবাল খান জানান, রাত পৌনে ৩টার দিকে খবর পেয়ে বুয়েটের চিকিৎসক পরীক্ষা করে আবরারকে মৃত ঘোষণা করেন।
আবরার হত্যায় নেপথ্যের কারিগর : ‘আড়িপেতে শোনা’ গ্রুপ
আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের মূল দৃশ্যপটে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা থাকলেও সে সময় আমার দেশের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, এ পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্র তৈরি করেছে বুয়েটের ‘আড়িপেতে শোনা’ নামক একটি ফেসবুক গ্রুপ। ফ্যাসিবাদী ও ইসলামবিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত এ গ্রুপটি বহু বছর ধরে বুয়েটে ভিন্নমতাবলম্বী ও ধার্মিক শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে নির্যাতন চালানোর পরিবেশ তৈরি করেছিল।
২০১২ সালে যাত্রা শুরু করা এ গ্রুপটি ২০১৩ সালে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময় থেকে শাহবাগপন্থী ও ইসলামবিদ্বেষী রূপধারণ করে। গ্রুপের তৎকালীন অ্যাডমিন প্যানেল ‘বুয়েটকে শিবিরমুক্ত করার’ প্রচার জোরদার করে। এর অংশ হিসেবে ২০১৪ সালে এ গ্রুপে ৪৪ জনের একটি নিষিদ্ধ তালিকা প্রকাশ করা হয়, যেখানে শিবির বা সরকারবিরোধী মত পোষণকারী শিক্ষার্থীদের নামও ছিল।
এ তালিকায় থাকা বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে অন্তত ১৪ জন ছাত্রলীগের নির্মম নির্যাতনের শিকার হন বলে জানা যায়। তালিকাটি তৈরি ও প্রকাশে তৎকালীন অ্যাডমিন প্যানেলের সদস্য জাভেদ ইকবাল (মেকানিক্যাল-৮৯), মিশকাত আল আলভি (ইইই-০৭), মাসুদ করিম খানসহ (সিএসই-৮৯) অনেকে জড়িত ছিলেন।
‘আড়িপেতে শোনা’ গ্রুপের চিহ্নিত সদস্যরা তালিকা প্রকাশের পাশাপাশি ক্যাম্পাসে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করে, যেখানে শিবির ট্যাগ দিয়ে কাউকে নির্যাতন করাকে অপরাধ হিসেবে দেখা হতো না, বরং বৈধতা দেওয়া হতো। তারা নানা পোস্টে শিবিরের কারো ওপর নির্যাতনকে ন্যায্য প্রমাণের জন্য যুক্তি দিত।
একপর্যায়ে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগ শিবিরমুক্ত করার নৃশংস অভিযান শুরু করে। তারা ধর্মভীরু শিক্ষার্থীদেরও শিবির আখ্যা দিয়ে নির্যাতন করত। অবস্থা এমনই ছিল যে, আড়িপাতা গ্রুপের নির্যাতনের ভয়ে নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের সহায়তা করার সাহসও পেত না সহপাঠীরা । আবরার ফাহাদ ছিলেন এ ফ্যাসিবাদী পরিবেশের সর্বশেষ ও সবচেয়ে মর্মান্তিক শিকার।
আড়িপাতা গ্রুপের উস্কানি এবং তালিকাভুক্ত শিক্ষার্থীদের অমানবিক নির্যাতনের পাশাপাশি এক্ষেত্রে বুয়েট প্রশাসনের সরাসরি সহযোগিতা বা নিষ্ক্রিয়তা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক। অভিযোগ ওঠে ২০১২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বুয়েটে ছাত্রলীগের সব বর্বরতা সম্পর্কে প্রশাসন অবগত ছিল, কিন্তু তারা কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে, বরং ছাত্রলীগকে নির্যাতনে সহায়তা করে।
হত্যাকাণ্ডের বিচার কত দূর
আবরার ফাহাদ নিহত হওয়ায় ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয় এবং বুয়েটের দীর্ঘদিনের অন্ধকার অধ্যায় জাতির সামনে উন্মোচিত হয়। পরবর্তী সময়ে আবরার হত্যার ঘটনায় ছাত্রলীগের ২৫ জনকে আটক করা হয়। ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত। এ মামলায় আরো পাঁচ শিক্ষার্থীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত। নিম্ন আদালতের রায় খতিয়ে ডেথ রেফারেন্স হিসেবে ২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি মামলার নথি হাইকোর্টে পৌঁছায়। গত বছরের ২৮ নভেম্বর হাইকোর্ট বেঞ্চে এ বিষয়ে শুনানি শুরু হয়। এদিকে আবরার ফাহাদ হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মুনতাসির আল জেমি গত বছরের ৬ আগস্ট কারাগার থেকে পালিয়ে যান।
বুয়েটের ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, এ হত্যাকাণ্ডের পরিবেশ তৈরির জন্য দায়ী ‘আড়িপাতা গ্রুপের’ অনেক সদস্য এবং নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমে সহায়তাকারী বুয়েট প্রশাসনের শিক্ষকরা রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন ধরে চলা এ ফ্যাসিবাদী পরিবেশ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। শিক্ষার্থীরা মনে করেন, আবরারের হত্যাকাণ্ড ছিল বছরের পর বছর ধরে গড়ে ওঠা একটি ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার অনিবার্য পরিণতি। আর শহীদ আবরার ফাহাদ হয়ে ওঠে আধিপত্যবাদবিরোধী এক অবিস্মরণীয় কণ্ঠস্বর।
সরকারের কর্মসূচি
শহীদ আবরার ফাহাদের ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকীতে আজ ৭ অক্টোবর সন্ধ্যা ৭টায় ঢাকাসহ দেশের সকল শিল্পকলা একাডেমিতে ‘ইউ ফেইলড টু কিল আবরার ফাহাদ’ প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হবে। ঢাকার প্রদর্শনীতে উপস্থিত থাকবেন আবরার ফাহাদের বাবা।
বর্তমানে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের জীবন ও তাঁদের সৃষ্টিকে উদযাপনের জন্য একটি ক্যালেন্ডার তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। এ ক্যালেন্ডারে সাংস্কৃতিক উৎসবের পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে আবরার ফাহাদের মৃত্যুবার্ষিকী ও বিডিআর ম্যাসাকার দিবস অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। ফলে এখন থেকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রতি বছর যথাক্রমে ৭ অক্টোবর ও ২৫ ফেব্রুয়ারি এই দুটি দিবস বিশেষভাবে পালিত হবে।
																			
																		
								                                        





















