1:33 am, Monday, 6 October 2025

শহরে ভুয়া সাংবাদিকদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ

এম রাসেল সরকার

vua journalist risingbd 2505040432

 

এম রাসেল সরকার:

সাংবাদিকতার নাম ভাঙিয়ে ভুয়া সাংবাদিকদের তৎপরতা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। যত্রতত্র ফেসবুক লাইভ, নামসর্বস্ব পত্রিকা ও অনলাইনের প্রেস লেখা স্টিকার ও আইডি কার্ড ঝুলিয়ে অবাধে চলাচল করছে সাংবাদিক নামধারী ভুয়া ব্যক্তিরা। পেটে বোমা মারলেও দু’লাইন লেখার যোগ্যতা নেই, অথচ রিপোর্টার পরিচয়ে তারাই খুলে বসেছে বহুমুখী প্রতারণার বাণিজ্য।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলা শহরে ভুয়া সাংবাদিকদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। নামসর্বস্ব পত্রিকা ও অনিবন্ধিত ভুঁইফোঁড় নিউজ পোর্টালের নামে কিছু আসাধু লোক সাংবাদিক পরিচয়ে জনসাধারণের কাছ থেকে প্রতারণা করে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। তারা যখন যেখানে ইচ্ছে হানা দিচ্ছে, সাধারণ মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করে ভয়ভীতি দেখিয়ে ফাঁদে ফেলছে।

এতে সাংবাদিকতার মতো একটি মহান পেশার মর্যাদা হুমকির মুখে পড়েছে। ভুয়া সাংবাদিকদের অপ্রতিরোধ্য দৌরাত্ম্যে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন প্রকৃত ও পেশাদার সাংবাদিকেরা। পাশাপাশি বিরক্ত হচ্ছেন প্রশাসনের লোকজন। তবে এসব প্রতারকের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। মাঝেমধ্যে প্রতারণার অভিযোগে দু-একজন গ্রেপ্তার হলেও জেল থেকে বের হয়ে ফের একই অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে তারা।

সাংবাদিকতার নামে প্রতারকদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনার তাগিদ দিয়েছেন পেশাদার সাংবাদিক সংগঠনের নেতারা। পাশাপাশি গণমাধ্যম ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণেরও তাগিদ দিয়েছেন তারা। তবে ভুয়া সাংবাদিক শনাক্তের পাশাপাশি অপসাংবাদিকতা রোধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর দেশের বিভিন্ন স্থানে অপরাধীরাও নিজেকে বাঁচাতে গলায় ভুঁইফোঁড় অনলাইন ও পত্রিকার কার্ড ঝুঁলিয়ে সাংবাদিক বনে গেছেন।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, চিহ্নিত মাদক কারবারি ও দেহব্যবসায়ীদের সহযোগী বানিয়ে প্রশাসনিক সহায়তা নিয়ে গড়ে উঠেছে ভুয়া সাংবাদিকদের ভয়ংকর সিন্ডিকেট। এরা প্রায়ই থানার দারোগাদের সঙ্গে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডায় মত্ত থাকে। পুলিশের ‘সোর্স’ হিসেবে তারাই বিশ্বস্ত, ঘুষ বাণিজ্যে পুলিশের সহায়ক হিসেবে কাজ করে। থানায় আসা-যাওয়া ভুক্তভোগী মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে হেনস্তা করা, আসামি ধরানো-ছাড়ানো, বিচার-সালিশের মাধ্যমে যে কোনো অপরাধের মীমাংসা করিয়ে দেওয়ার মতো জঘন্য দালালিতে মেতে উঠেছে এসব প্রতারক। এ ছাড়া এই চক্রগুলো দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দপ্তরে গিয়ে দেশের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে। মিথ্যা-বানোয়াট সংবাদ প্রচারের কথা বলে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে থাকে।

বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে মিথ্যা সংবাদ করার কথা বলে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। তাদের দাবিকৃত চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যা ও বানোয়াট গল্প সাজিয়ে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক ও ভুঁইফোঁড় অনলাইনে প্রকাশ ও প্রচার করছে ভুয়া সাংবাদিকেরা। এদের অপতৎপরতা থেকে বাঁচতে অন্তর্বর্তী সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় ও পুলিশের সাইবার-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যারা সরকারের অনুমোদন ছাড়া নিউজ পোর্টাল চলাবে, একই সঙ্গে মিথ্যা তথ্য দিয়ে অপপ্রচার করে মানুষকে বিব্রত করবে অথবা অনৈতিকভাবে নিউজ করে মানুষকে হয়রানি করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ভুয়া সাংবাদিকদের বিষয়ে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের সচিব মো. আব্দুস সবুর বলেন, এদের প্রতারণার কথা আমাদের কানেও আসে। নামধারি এসব সাংবাদিকের কারণে যাতে পেশাদার সাংবাদিকদের কোনো ক্ষতি বা বদনাম না হয়, সেই ব্যবস্থা করা হবে। এরই মধ্যে চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ফেনীসহ বেশ কয়েকটি জেলায় আমাদের কাজ শুরু করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি কর্মশালার ব্যবস্থা করা হবে। শিগগিরই ঢাকার সাংবাদিকদের সঙ্গে নিয়ে একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ভুয়া ও অপসাংবাদিকতা রুখতে কিছু কাজ শুরু হয়েছে। শিগগিরই আরও বড় পরিসরে সবাইকে নিয়ে কাজ করতে পারব।

অভিযোগ রয়েছে, সাংবাদিক পরিচয়ে চক্রগুলো ছিনতাই, চাঁদাবাজি, জমি দখল, দোকানপাট দখল, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপকর্মে জড়িত হয়ে পড়ছে। চক্রে নারী সদস্যও থাকেন। এরা মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাসে ‘প্রেস’ কিংবা ‘সংবাদপত্র’ লিখে পুলিশের সামনে দিয়েই নির্বিঘ্নে দাবড়ে বেড়ায়। এদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও বিভিন্ন যানবাহনও থাকে চোরাই এবং সম্পূর্ণ কাগজপত্রবিহীন।

রাজধানী ঢাকার ডেমরা, গুলশান-বনানী, উত্তরা, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, কদমতলীসহ ঢাকার আশপাশ এলাকায় ভুয়া সাংবাদিকদের সবচেয়ে বেশি দৌরাত্ম্য।

এ ছাড়া ঢাকার আশপাশ জেলাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কথিত সাংবাদিকেরা নানা সিন্ডিকেটে বিভক্ত হয়ে অভিনব সব কৌশলে প্রতারণা চালিয়ে আসছে। প্রতিটি সিন্ডিকেটের পক্ষ থেকেই তথাকথিত ‘অনলাইন নিউজ পোর্টাল’ তৈরি করে তার আওতায় নিজেদের আইডি কার্ডও বানিয়ে নেয় তারা। গণ্ডমূর্খ একেকজন রাতারাতি চিফ রিপোর্টার, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, নিউজ এডিটর, এডিটর পদবি ধারণ করে রংবেরঙের ভিজিটিং কার্ড বিলিয়ে বেড়ান, যত্রতত্র গড়ে তোলেন প্রেসক্লাব, রিপোর্টার্স ক্লাব, ক্রাইম রিপোর্টার্স সোসাইটি ইত্যাদি নামের ভুঁইফোঁড় সংগঠন। এসব সংগঠনের ব্যানারেও চলে নানা অজুহাতের চাঁদাবাজি।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার (সিপিসি) জানিয়েছে, বেশ কিছু অনিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টালের বিরুদ্ধে হয়রানি ও ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগ রয়েছে। বিষয়গুলো তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, অসংখ্য অনিবন্ধিত অনলাইন পোর্টালে কিছু স্বল্পশিক্ষিত লোক ‘সাংবাদিক’ সেজে মোটরসাইকেলে ‘প্রেস’ ও ‘সাংবাদিক’ লিখে বোকা বানাচ্ছেন বিভিন্ন মহলকে। ঢাকা থেকে বেশির ভাগ অনলাইন পোর্টাল ও দৈনিক পত্রিকা নামমাত্র সংখ্যায় মাঝেমধ্যে প্রকাশ করা হয়। কোনো বেতনক্রম নেই তাদের। একটি পরিচয়পত্র দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। এমন ‘পরিচয়পত্রধারী সাংবাদিকদের’ সঙ্গে অপরাধ জগতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে। তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতার সুযোগে যে কেউ ঘরে বসে একটি সংবাদমাধ্যম খুলে বসার সুযোগ পাচ্ছে। অল্প খরচে একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল চালু করে যে কেউ অললাইন মিডিয়ার ‘মালিক’, ‘সম্পাদক’, ‘সাংবাদিক’, ‘রিপোর্টার’ বনে যাচ্ছে। ভুয়া সাংবাদিকদের সাধারণ মানুষ সহজে চিহ্নিত করতে পারে না। এমনকি পেশাদার সাংবাদিকেরাও মাঝেমধ্যে বিভ্রান্ত হন।

তথ্য অধিদপ্তরের প্রধান তথ্য অফিসার মো. নিজামূল কবীর বলেন, অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে অপপ্রচার করে মানুষকে বিব্রত করা অথবা যারা অনৈতিকভাবে নিউজ করে মানুষকে হয়রানি করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এরই মধ্যে তথ্য অধিদপ্তর কাজ শুরু করেছে।

ভুঁইফোঁড় অনলাইন বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে নিজামূল কবীর বলেন, সাংবাদিকতার নামে অপসাংবাদিকতা করতে দেওয়া হবে না। অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টালগুলো একসঙ্গে দুটো অপরাধ করছে, এক হচ্ছে সরকারের অনুমোদন না নিয়ে নিউজ পোর্টাল চালাচ্ছে। আর দ্বিতীয়তটি সাংবাদিকতার নামে মানুষকে হয়রানি করছে। এটা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। তাই অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টালের বিরুদ্ধে দ্রæতই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সাধারণ সম্পাদক খুরশীদ আলম বলেন, একশ্রেণির নামসর্বস্ব পত্রিকার সম্পাদকেরা ভুয়া সাংবাদিকদের দিয়ে সিন্ডিকেট করে ব্ল্যাকমেইলিং করে থাকেন। তাদের কারণে পেশাদার সাংবাদিকদের সম্মানহানি হচ্ছে। এই চক্রগুলো প্রতিহত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কঠোর হতে হবে। পাশাপাশি এদের যেখানেই পাওয়া যাবে, ধরে আইনের হাতে সোপর্দ করতে হবে।

 

 

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

Update Time : 11:53:21 am, Wednesday, 1 October 2025
150 Time View

শহরে ভুয়া সাংবাদিকদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ

Update Time : 11:53:21 am, Wednesday, 1 October 2025

 

এম রাসেল সরকার:

সাংবাদিকতার নাম ভাঙিয়ে ভুয়া সাংবাদিকদের তৎপরতা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। যত্রতত্র ফেসবুক লাইভ, নামসর্বস্ব পত্রিকা ও অনলাইনের প্রেস লেখা স্টিকার ও আইডি কার্ড ঝুলিয়ে অবাধে চলাচল করছে সাংবাদিক নামধারী ভুয়া ব্যক্তিরা। পেটে বোমা মারলেও দু’লাইন লেখার যোগ্যতা নেই, অথচ রিপোর্টার পরিচয়ে তারাই খুলে বসেছে বহুমুখী প্রতারণার বাণিজ্য।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলা শহরে ভুয়া সাংবাদিকদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। নামসর্বস্ব পত্রিকা ও অনিবন্ধিত ভুঁইফোঁড় নিউজ পোর্টালের নামে কিছু আসাধু লোক সাংবাদিক পরিচয়ে জনসাধারণের কাছ থেকে প্রতারণা করে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। তারা যখন যেখানে ইচ্ছে হানা দিচ্ছে, সাধারণ মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করে ভয়ভীতি দেখিয়ে ফাঁদে ফেলছে।

এতে সাংবাদিকতার মতো একটি মহান পেশার মর্যাদা হুমকির মুখে পড়েছে। ভুয়া সাংবাদিকদের অপ্রতিরোধ্য দৌরাত্ম্যে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন প্রকৃত ও পেশাদার সাংবাদিকেরা। পাশাপাশি বিরক্ত হচ্ছেন প্রশাসনের লোকজন। তবে এসব প্রতারকের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। মাঝেমধ্যে প্রতারণার অভিযোগে দু-একজন গ্রেপ্তার হলেও জেল থেকে বের হয়ে ফের একই অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে তারা।

সাংবাদিকতার নামে প্রতারকদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনার তাগিদ দিয়েছেন পেশাদার সাংবাদিক সংগঠনের নেতারা। পাশাপাশি গণমাধ্যম ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণেরও তাগিদ দিয়েছেন তারা। তবে ভুয়া সাংবাদিক শনাক্তের পাশাপাশি অপসাংবাদিকতা রোধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর দেশের বিভিন্ন স্থানে অপরাধীরাও নিজেকে বাঁচাতে গলায় ভুঁইফোঁড় অনলাইন ও পত্রিকার কার্ড ঝুঁলিয়ে সাংবাদিক বনে গেছেন।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, চিহ্নিত মাদক কারবারি ও দেহব্যবসায়ীদের সহযোগী বানিয়ে প্রশাসনিক সহায়তা নিয়ে গড়ে উঠেছে ভুয়া সাংবাদিকদের ভয়ংকর সিন্ডিকেট। এরা প্রায়ই থানার দারোগাদের সঙ্গে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডায় মত্ত থাকে। পুলিশের ‘সোর্স’ হিসেবে তারাই বিশ্বস্ত, ঘুষ বাণিজ্যে পুলিশের সহায়ক হিসেবে কাজ করে। থানায় আসা-যাওয়া ভুক্তভোগী মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে হেনস্তা করা, আসামি ধরানো-ছাড়ানো, বিচার-সালিশের মাধ্যমে যে কোনো অপরাধের মীমাংসা করিয়ে দেওয়ার মতো জঘন্য দালালিতে মেতে উঠেছে এসব প্রতারক। এ ছাড়া এই চক্রগুলো দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দপ্তরে গিয়ে দেশের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে। মিথ্যা-বানোয়াট সংবাদ প্রচারের কথা বলে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে থাকে।

বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে মিথ্যা সংবাদ করার কথা বলে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। তাদের দাবিকৃত চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যা ও বানোয়াট গল্প সাজিয়ে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক ও ভুঁইফোঁড় অনলাইনে প্রকাশ ও প্রচার করছে ভুয়া সাংবাদিকেরা। এদের অপতৎপরতা থেকে বাঁচতে অন্তর্বর্তী সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় ও পুলিশের সাইবার-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যারা সরকারের অনুমোদন ছাড়া নিউজ পোর্টাল চলাবে, একই সঙ্গে মিথ্যা তথ্য দিয়ে অপপ্রচার করে মানুষকে বিব্রত করবে অথবা অনৈতিকভাবে নিউজ করে মানুষকে হয়রানি করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ভুয়া সাংবাদিকদের বিষয়ে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের সচিব মো. আব্দুস সবুর বলেন, এদের প্রতারণার কথা আমাদের কানেও আসে। নামধারি এসব সাংবাদিকের কারণে যাতে পেশাদার সাংবাদিকদের কোনো ক্ষতি বা বদনাম না হয়, সেই ব্যবস্থা করা হবে। এরই মধ্যে চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ফেনীসহ বেশ কয়েকটি জেলায় আমাদের কাজ শুরু করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি কর্মশালার ব্যবস্থা করা হবে। শিগগিরই ঢাকার সাংবাদিকদের সঙ্গে নিয়ে একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ভুয়া ও অপসাংবাদিকতা রুখতে কিছু কাজ শুরু হয়েছে। শিগগিরই আরও বড় পরিসরে সবাইকে নিয়ে কাজ করতে পারব।

অভিযোগ রয়েছে, সাংবাদিক পরিচয়ে চক্রগুলো ছিনতাই, চাঁদাবাজি, জমি দখল, দোকানপাট দখল, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপকর্মে জড়িত হয়ে পড়ছে। চক্রে নারী সদস্যও থাকেন। এরা মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাসে ‘প্রেস’ কিংবা ‘সংবাদপত্র’ লিখে পুলিশের সামনে দিয়েই নির্বিঘ্নে দাবড়ে বেড়ায়। এদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও বিভিন্ন যানবাহনও থাকে চোরাই এবং সম্পূর্ণ কাগজপত্রবিহীন।

রাজধানী ঢাকার ডেমরা, গুলশান-বনানী, উত্তরা, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, কদমতলীসহ ঢাকার আশপাশ এলাকায় ভুয়া সাংবাদিকদের সবচেয়ে বেশি দৌরাত্ম্য।

এ ছাড়া ঢাকার আশপাশ জেলাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কথিত সাংবাদিকেরা নানা সিন্ডিকেটে বিভক্ত হয়ে অভিনব সব কৌশলে প্রতারণা চালিয়ে আসছে। প্রতিটি সিন্ডিকেটের পক্ষ থেকেই তথাকথিত ‘অনলাইন নিউজ পোর্টাল’ তৈরি করে তার আওতায় নিজেদের আইডি কার্ডও বানিয়ে নেয় তারা। গণ্ডমূর্খ একেকজন রাতারাতি চিফ রিপোর্টার, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, নিউজ এডিটর, এডিটর পদবি ধারণ করে রংবেরঙের ভিজিটিং কার্ড বিলিয়ে বেড়ান, যত্রতত্র গড়ে তোলেন প্রেসক্লাব, রিপোর্টার্স ক্লাব, ক্রাইম রিপোর্টার্স সোসাইটি ইত্যাদি নামের ভুঁইফোঁড় সংগঠন। এসব সংগঠনের ব্যানারেও চলে নানা অজুহাতের চাঁদাবাজি।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার (সিপিসি) জানিয়েছে, বেশ কিছু অনিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টালের বিরুদ্ধে হয়রানি ও ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগ রয়েছে। বিষয়গুলো তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, অসংখ্য অনিবন্ধিত অনলাইন পোর্টালে কিছু স্বল্পশিক্ষিত লোক ‘সাংবাদিক’ সেজে মোটরসাইকেলে ‘প্রেস’ ও ‘সাংবাদিক’ লিখে বোকা বানাচ্ছেন বিভিন্ন মহলকে। ঢাকা থেকে বেশির ভাগ অনলাইন পোর্টাল ও দৈনিক পত্রিকা নামমাত্র সংখ্যায় মাঝেমধ্যে প্রকাশ করা হয়। কোনো বেতনক্রম নেই তাদের। একটি পরিচয়পত্র দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। এমন ‘পরিচয়পত্রধারী সাংবাদিকদের’ সঙ্গে অপরাধ জগতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে। তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতার সুযোগে যে কেউ ঘরে বসে একটি সংবাদমাধ্যম খুলে বসার সুযোগ পাচ্ছে। অল্প খরচে একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল চালু করে যে কেউ অললাইন মিডিয়ার ‘মালিক’, ‘সম্পাদক’, ‘সাংবাদিক’, ‘রিপোর্টার’ বনে যাচ্ছে। ভুয়া সাংবাদিকদের সাধারণ মানুষ সহজে চিহ্নিত করতে পারে না। এমনকি পেশাদার সাংবাদিকেরাও মাঝেমধ্যে বিভ্রান্ত হন।

তথ্য অধিদপ্তরের প্রধান তথ্য অফিসার মো. নিজামূল কবীর বলেন, অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে অপপ্রচার করে মানুষকে বিব্রত করা অথবা যারা অনৈতিকভাবে নিউজ করে মানুষকে হয়রানি করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এরই মধ্যে তথ্য অধিদপ্তর কাজ শুরু করেছে।

ভুঁইফোঁড় অনলাইন বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে নিজামূল কবীর বলেন, সাংবাদিকতার নামে অপসাংবাদিকতা করতে দেওয়া হবে না। অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টালগুলো একসঙ্গে দুটো অপরাধ করছে, এক হচ্ছে সরকারের অনুমোদন না নিয়ে নিউজ পোর্টাল চালাচ্ছে। আর দ্বিতীয়তটি সাংবাদিকতার নামে মানুষকে হয়রানি করছে। এটা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। তাই অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টালের বিরুদ্ধে দ্রæতই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সাধারণ সম্পাদক খুরশীদ আলম বলেন, একশ্রেণির নামসর্বস্ব পত্রিকার সম্পাদকেরা ভুয়া সাংবাদিকদের দিয়ে সিন্ডিকেট করে ব্ল্যাকমেইলিং করে থাকেন। তাদের কারণে পেশাদার সাংবাদিকদের সম্মানহানি হচ্ছে। এই চক্রগুলো প্রতিহত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কঠোর হতে হবে। পাশাপাশি এদের যেখানেই পাওয়া যাবে, ধরে আইনের হাতে সোপর্দ করতে হবে।