6:04 pm, Tuesday, 4 November 2025

খাদ্য কর্মকর্তা শহীদুল্লাহর বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ: ব্যক্তিগত হিসাব নম্বরে মিল কোটি টাকা

দিগন্ত প্রতিদিন

kurigram1 c6380290b33d65285f34a4e471aa57f8

 

বিশেষ প্রতিনিধি:
কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক ও সরকারি খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (এলএসডি) মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর বিরুদ্ধে সরকারি গুদামে চাল সরবরাহে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। চাল সংগ্রহ ও বিতরণে অনিয়ম করে তিনি ব্যাংকের ব্যক্তিগত হিসাব নম্বরে কোটি টাকা লেনদেন করেছেন ব‌লেও অ‌ভি‌যোগ উ‌ঠে‌ছে। তার একাধিক ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের সত্যতা পাওয়া গেছে।

এদিকে সরকারি চাল সংগ্রহ কর্মসূচিতে মিল মালিকদের দেওয়া চালের বিল আত্মসাতসহ নিয়ম বহির্ভূতভাবে নিম্নমানের চাল গুদামজাত করায় এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সম্প্রতি আদালতে মামলা করেছেন রৌমারীর চালকল মালিক নাসির উদ্দিন লাল। এরপরই তাকে রৌমারী থেকে দিনাজপুরের বিরামপুরে বদলির আদেশ জারি করে কর্তৃপক্ষ। তবে তার বিরুদ্ধে এখনও কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

অনুসন্ধান ও অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে রৌমারী খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে যোগদানের পর থেকে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ধান ক্রয়, আর্থিক সুবিধা নিয়ে নিম্নমানের চাল সংগ্রহ, চাল বিতরণে ঘুষ বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ দীর্ঘদিনের। পূর্বের কর্মস্থল ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলার যাদুরানী খাদ্যগুদামে কর্মকালীনও তার বিরুদ্ধে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। এসব অনিয়ম-দুর্নীতির খবর একাধিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হলেও তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত কিংবা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি খাদ্য বিভাগ।

সম্প্রতি রৌমারীতে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে নিম্নমানের চাল বিতরণের অভিযোগসহ তার বিরুদ্ধে নিম্নমানের চাল গুদামজাত করার অভিযোগ ওঠে। উপজেলা প্রশাসনের অভিযানে কয়েকটি ডিলার পয়েন্টে নিম্নমানের চালের সন্ধান পাওয়া যায়। এ ছাড়া গত বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সরকারি গুদাম থেকে চাল বের করার সময় স্থানীয় জনতা দুই ট্রাক নিম্নমানের চাল আটক করে।

গুদাম কর্মকর্তা শহীদুল্লাহর বিরুদ্ধে করা মামলার বাদী নাসির উদ্দিন লাল বলেন, ‘শামীম এন্টারপ্রাইজ নামের সরকারি গুদামের তালিকায় কোনও মিল-চাতাল নেই। গুদাম কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে শামীম এন্টারপ্রাইজের নামে আমার সরবরাহ করা ১০ টন চালের টাকা তুলে আত্মসাৎ করেন। এর আগে গত আমন মৌসুমে তিন লক্ষাধিক টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন দফতরে লিখিত অভিযোগ দিলেও কোনও প্রতিকার পাইনি। আমি বাধ্য হয়ে আদালতে মামলা করেছি।’

এই ব্যবসায়ীর অভিযোগের সূত্র ধরে অনুসন্ধান করে গুদাম কর্মকর্তার ব্যক্তিগত হিসাব নম্বরে অস্বাভাবিক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সোনালী ব্যাংক রৌমারী শাখা এবং ময়মনসিংহ শাখায় তার ব্যক্তিগত সঞ্চয়ী হিসাব নম্বরে এসব লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া যায়।

সোনালী ব্যাংক রৌমারী শাখার হিসাব নম্বরের তথ্য যাচাই করে দেখা গেছে, ২০২৫ সালের ২৫ মে তার হিসাব নম্বরে ৫৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা জমা হয়। ২ জুন হিসাব নম্বরে ২৭ লাখ ১০ হাজার টাকা জমা হয়। ৩ জুন রৌমারীর কর্তিমারী শাখা থেকে চেকের মাধ্যমে একবারে ৩৩ লাখ ১০ হাজার টাকা উত্তোলন করেন এই গুদাম কর্মকর্তা। ২৫ মে থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত ওই হিসাব নম্বরে ৮২ লাখ টাকার জমা ও উত্তোলন হয়েছে।

অনুসন্ধানে এই কর্মকর্তার আরেকটি হিসাব নম্বরের তথ্য পাওয়া গেছে। ময়মনসিংহ সোনালী ব্যাংক শাখার সেই নম্বরে লেনদেনের তথ্য চোখ ছানাবড়া হওয়ার মতো। ২০২৫ সালের ১ জুন থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওই হিসাব নম্বরে প্রায় কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। রৌমারী এবং কুড়িগ্রাম শহর থেকেও ওই হিসাব নম্বরে টাকা পাঠানো হয়েছে। ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওই হিসাব নম্বরে স্থিতি ছিল ৫ লক্ষাধিক টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একজন সরকারি কর্মচারীর ব্যাংক হিসাব নম্বরে এমন লেনদেন অস্বাভাবিক। এসব টাকার উৎস কী, তা তদন্তের দাবি রাখে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এমন অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবর পাঠিয়েছে কিনা তাও খতিয়ে দেখার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত এলএসডি কর্মকর্তা মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘বিষয়টি তদন্তাধীন। তদন্ত হলে সত্য বেরিয়ে আসবে। তবে আমি এসব করি না।’

ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রৌমারী থেকে আমার চাচাতো ভাই গরু কিনে নিয়ে যেতেন। ওই টাকা আমার অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন করেছেন। এর বাইরে কিছু নাই। তবে সরকারি কর্মচারী হিসেবে এভাবে লেনদেন করা ঠিক হয়নি আমরা।’

আরেকটি হিাসব নম্বরে অস্বাভাবিক লেনদেন থাকার প্রশ্নে এই খাদ্য পরিদর্শক বলেন, ‘আমার ভাইয়েরা ব্যবসা করেন। সেই লেনদেন হয়েছে ওই হিসাব নম্বরে। কিন্তু এসব নিয়ে তো সাংবাদিকদের কাজ করার কথা নয়। আপনি অফিসে আসেন। বসে আমরা কথা বলবো।’

এ ব্যাপারে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক হামিদুল হক বলেন, ‘ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। কমিটি এসব অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন দিলে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবো।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

Update Time : 05:19:56 am, Sunday, 21 September 2025
78 Time View

খাদ্য কর্মকর্তা শহীদুল্লাহর বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ: ব্যক্তিগত হিসাব নম্বরে মিল কোটি টাকা

Update Time : 05:19:56 am, Sunday, 21 September 2025

 

বিশেষ প্রতিনিধি:
কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক ও সরকারি খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (এলএসডি) মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর বিরুদ্ধে সরকারি গুদামে চাল সরবরাহে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। চাল সংগ্রহ ও বিতরণে অনিয়ম করে তিনি ব্যাংকের ব্যক্তিগত হিসাব নম্বরে কোটি টাকা লেনদেন করেছেন ব‌লেও অ‌ভি‌যোগ উ‌ঠে‌ছে। তার একাধিক ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের সত্যতা পাওয়া গেছে।

এদিকে সরকারি চাল সংগ্রহ কর্মসূচিতে মিল মালিকদের দেওয়া চালের বিল আত্মসাতসহ নিয়ম বহির্ভূতভাবে নিম্নমানের চাল গুদামজাত করায় এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সম্প্রতি আদালতে মামলা করেছেন রৌমারীর চালকল মালিক নাসির উদ্দিন লাল। এরপরই তাকে রৌমারী থেকে দিনাজপুরের বিরামপুরে বদলির আদেশ জারি করে কর্তৃপক্ষ। তবে তার বিরুদ্ধে এখনও কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

অনুসন্ধান ও অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে রৌমারী খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে যোগদানের পর থেকে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ধান ক্রয়, আর্থিক সুবিধা নিয়ে নিম্নমানের চাল সংগ্রহ, চাল বিতরণে ঘুষ বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ দীর্ঘদিনের। পূর্বের কর্মস্থল ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলার যাদুরানী খাদ্যগুদামে কর্মকালীনও তার বিরুদ্ধে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। এসব অনিয়ম-দুর্নীতির খবর একাধিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হলেও তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত কিংবা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি খাদ্য বিভাগ।

সম্প্রতি রৌমারীতে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে নিম্নমানের চাল বিতরণের অভিযোগসহ তার বিরুদ্ধে নিম্নমানের চাল গুদামজাত করার অভিযোগ ওঠে। উপজেলা প্রশাসনের অভিযানে কয়েকটি ডিলার পয়েন্টে নিম্নমানের চালের সন্ধান পাওয়া যায়। এ ছাড়া গত বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সরকারি গুদাম থেকে চাল বের করার সময় স্থানীয় জনতা দুই ট্রাক নিম্নমানের চাল আটক করে।

গুদাম কর্মকর্তা শহীদুল্লাহর বিরুদ্ধে করা মামলার বাদী নাসির উদ্দিন লাল বলেন, ‘শামীম এন্টারপ্রাইজ নামের সরকারি গুদামের তালিকায় কোনও মিল-চাতাল নেই। গুদাম কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে শামীম এন্টারপ্রাইজের নামে আমার সরবরাহ করা ১০ টন চালের টাকা তুলে আত্মসাৎ করেন। এর আগে গত আমন মৌসুমে তিন লক্ষাধিক টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন দফতরে লিখিত অভিযোগ দিলেও কোনও প্রতিকার পাইনি। আমি বাধ্য হয়ে আদালতে মামলা করেছি।’

এই ব্যবসায়ীর অভিযোগের সূত্র ধরে অনুসন্ধান করে গুদাম কর্মকর্তার ব্যক্তিগত হিসাব নম্বরে অস্বাভাবিক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সোনালী ব্যাংক রৌমারী শাখা এবং ময়মনসিংহ শাখায় তার ব্যক্তিগত সঞ্চয়ী হিসাব নম্বরে এসব লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া যায়।

সোনালী ব্যাংক রৌমারী শাখার হিসাব নম্বরের তথ্য যাচাই করে দেখা গেছে, ২০২৫ সালের ২৫ মে তার হিসাব নম্বরে ৫৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা জমা হয়। ২ জুন হিসাব নম্বরে ২৭ লাখ ১০ হাজার টাকা জমা হয়। ৩ জুন রৌমারীর কর্তিমারী শাখা থেকে চেকের মাধ্যমে একবারে ৩৩ লাখ ১০ হাজার টাকা উত্তোলন করেন এই গুদাম কর্মকর্তা। ২৫ মে থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত ওই হিসাব নম্বরে ৮২ লাখ টাকার জমা ও উত্তোলন হয়েছে।

অনুসন্ধানে এই কর্মকর্তার আরেকটি হিসাব নম্বরের তথ্য পাওয়া গেছে। ময়মনসিংহ সোনালী ব্যাংক শাখার সেই নম্বরে লেনদেনের তথ্য চোখ ছানাবড়া হওয়ার মতো। ২০২৫ সালের ১ জুন থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওই হিসাব নম্বরে প্রায় কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। রৌমারী এবং কুড়িগ্রাম শহর থেকেও ওই হিসাব নম্বরে টাকা পাঠানো হয়েছে। ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওই হিসাব নম্বরে স্থিতি ছিল ৫ লক্ষাধিক টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একজন সরকারি কর্মচারীর ব্যাংক হিসাব নম্বরে এমন লেনদেন অস্বাভাবিক। এসব টাকার উৎস কী, তা তদন্তের দাবি রাখে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এমন অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবর পাঠিয়েছে কিনা তাও খতিয়ে দেখার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত এলএসডি কর্মকর্তা মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘বিষয়টি তদন্তাধীন। তদন্ত হলে সত্য বেরিয়ে আসবে। তবে আমি এসব করি না।’

ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রৌমারী থেকে আমার চাচাতো ভাই গরু কিনে নিয়ে যেতেন। ওই টাকা আমার অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন করেছেন। এর বাইরে কিছু নাই। তবে সরকারি কর্মচারী হিসেবে এভাবে লেনদেন করা ঠিক হয়নি আমরা।’

আরেকটি হিাসব নম্বরে অস্বাভাবিক লেনদেন থাকার প্রশ্নে এই খাদ্য পরিদর্শক বলেন, ‘আমার ভাইয়েরা ব্যবসা করেন। সেই লেনদেন হয়েছে ওই হিসাব নম্বরে। কিন্তু এসব নিয়ে তো সাংবাদিকদের কাজ করার কথা নয়। আপনি অফিসে আসেন। বসে আমরা কথা বলবো।’

এ ব্যাপারে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক হামিদুল হক বলেন, ‘ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। কমিটি এসব অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন দিলে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবো।