4:06 am, Monday, 6 October 2025

মওদূদীর বই বেছে বেছে নিষিদ্ধ করছে তালেবান: সালাফি হটাও’ পদক্ষেপ জোরদার আফগানিস্তান

দিগন্ত প্রতিদিন

taliban book

আন্তর্জাতিক ডেস্ক­:
আফগানিস্তানে ক্ষমতাসীন তালেবান প্রশাসনের ‘শরিয়াহ বিরোধী’ বই নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কিছু সংবাদমাধ্যমে ‘শুধু নারীদের লেখা বই’ নিষিদ্ধের খবর এলেও প্রকৃতপক্ষে নিষিদ্ধ বইয়ের অধিকাংশই পুরুষদের লেখা। তালেবান মূলত সালাফি মতবাদ ঘনিষ্ঠ বই-পুস্তক নিষিদ্ধে গুরুত্ব দিচ্ছে। যদিও তারা সেটি স্পষ্ট করেনি। রীতিমতো কমিটি করে পর্যালোচনার ভিত্তিতে বইয়ের তালিকা করছে তালেবান।

তালেবানের এমন পদক্ষেপে খেপেছে ইসলামিক স্টেট (আইএস) গোষ্ঠী। এটি অনলাইনে সালাফি ও জিহাদিদের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। তারা এখন তালেবানকে অযোগ্য প্রমাণ করতে এবং সালাফিদের তালেবানের বিরুদ্ধে উসকে দিতে উঠেপড়ে লেগেছে।

নিষিদ্ধের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তালেবানের নজরে ওয়াহহাবিবাদী কিতাব। গত বছরের শেষ নাগাদ অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে ‘ওয়াহহাবিবাদী’ পুস্তক ‘কিতাব আত-তাওহিদ’ নিষিদ্ধ করে। এর প্রতিবাদে আইএস তাদের অনলাইন ম্যাগাজিন আন-নাবা-তে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। আইএস তালেবানের পদক্ষেপকে সেইসব ‘মুরতাদ’ বা ‘ধর্মত্যাগী’ আরব শাসকদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তুলনা করে, যাদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বকে সন্তুষ্ট করার এবং ইসলামকে দুর্বল করার অভিযোগ রয়েছে। আইএস দাবি করে, তালেবান কর্মকর্তারা বইটি নিষিদ্ধ করার কারণ হিসেবে বলেছে, এর কিছু অংশ আইএস অনুসারীরা ‘তাকফির’ (মুসলিমদের অতিমাত্রায় ধর্মচ্যুত করা) প্রচারে ব্যবহার করতে পারে।

গত বছরের নভেম্বরে তালেবান প্রায় ৪০০ বই নিষিদ্ধ করার একটি বৃহত্তর নীতির অংশ হিসেবে এই বইটি নিষিদ্ধ করলেও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের মাধ্যমে জানুয়ারিতে এটি সবার নজরে আসে। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত আইএস-এর অনলাইন পত্রিকা আন-নাবা-এর সম্পাদকীয়তে বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলোচনা করা হয়। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তালেবানের ধর্মীয় ত্রুটি খুঁজে বের করতে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আইএস। কিন্তু বই নিষিদ্ধের প্রতিক্রিয়া জানাতে তারা কেন এত দেরি করেছে সেটি আশ্চর্যের।তালেবানের ‘কিতাব আত-তাওহিদ’ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তটি গত বছরের নভেম্বরে আফগানিস্তানের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক ঘোষিত ৪০০টি বই নিষিদ্ধ করার একটি বৃহত্তর নীতির অংশ ছিল। তবে, এই নির্দিষ্ট সালাফি বইটি নিয়ে বিতর্ক জানুয়ারিতেই জনসমক্ষে আসে, যখন কিছু সাংবাদিক এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী লক্ষ্য করেন যে, বইটি নিষিদ্ধ তালিকার ৩৯ নম্বরে রয়েছে। বইটি নিষিদ্ধ করার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, এটি আফগানিস্তানের ‘জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে’ যায়।

তালেবানের সালাফি-বিরোধী পদক্ষেপ!

গত জানুয়ারিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইসলামপন্থী ও জিহাদি আলেম এবং নেটিজেন ১৮ শতকের সৌদি পণ্ডিত মুহাম্মদ বিন আবদ আল-ওয়াহহাবের লেখা ‘কিতাব আত-তাওহিদ’ নিষিদ্ধ করার প্রতিক্রিয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। মুহাম্মদ বিন আবদ আল-ওয়াহহাব (১৭০৩-৯২) ওয়াহহাবিবাদের মূল ব্যক্তিত্ব। এটি ইসলামের কঠোর, আক্ষরিক ব্যাখ্যার পক্ষের একটি চিন্তাধারা।

সালাফিবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ওয়াহহাবিবাদ প্রায়শই জিহাদি এবং সালাফি আলেমরা গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় চিন্তাধারা বলে মনে করেন। এই দলে আইএস-ও রয়েছে। আইএস-এর সদস্যরা আফগানিস্তানে তাদের তথাকথিত খোরাসান প্রদেশ শাখার (আইএসকেপি) মাধ্যমে সক্রিয়।অবশ্য, কিছু দেশের সরকার এবং সালাফি-বিরোধীরা প্রায়শই কাউকে ‘ওয়াহহাবি’ শব্দটি ‘চরমপন্থী’ বা ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করতে অবজ্ঞাসূচক অর্থে ব্যবহার করে।তালেবান এই প্রথম সালাফি ঘরানার কিতাব, চিন্তাধারা এবং পণ্ডিতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে এমন নয়। এসব পদক্ষেপের মূল কারণ স্পষ্টতই দেশে আইএস-এর চরমপন্থী মতাদর্শের বিস্তার রোধ করা। এই গ্রুপগুলো প্রায়শই তালেবানের বিরুদ্ধে উসকানি দেয়।

গত জানুয়ারিতে তালেবান পূর্ব কুনার প্রদেশে সালাফি মাদ্রাসাগুলো বন্ধ করে দেয়, এই মতাদর্শের অনুসারীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি সংস্থা থেকে বরখাস্ত করে এবং তাদের প্রভাব কমাতে বিদেশি আর্থিক সহায়তা বন্ধ করার পদক্ষেপ নেয়। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আফগান শাসকেরা সালাফিদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে শুরু করে এবং আফগানিস্তানের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে হানাফি মাজহাবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বইগুলো সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়। তালেবানের সদস্যরা হানাফি ইসলামের দেওবন্দী মাজহাবের অনুসারী। তারা সালাফিদের, বিশেষ করে আফগানিস্তানে আইএস-এর কর্মকাণ্ড এবং নিয়োগ প্রচেষ্টাকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখে।আরবি-ভাষী ইসলামপন্থীদের মধ্যে অনলাইন আলোচনা এবং সাম্প্রতিক আইএস পত্রিকার সম্পাদকীয় অনুসারে, কিছু তালেবান সদস্য ‘কিতাব আত-তাওহিদ’ নিষিদ্ধ করার কারণ হিসেবে বলেছেন, তাঁরা বই বা এর লেখকের বিরোধী নন। বরং তাঁদের উদ্বেগ হলো, এই লেখাটিকে বাড়াবাড়ি রকমের চরমপন্থা, বিশেষ করে ‘তাকফির’ (মুসলিমদের ধর্মচ্যুত করা) প্রচারে অপব্যবহার করা হয়েছে। এটি আইএস সমর্থকেরাই করেছে।

গণতান্ত্রিক আমিরাতের পথে যাত্রা!

গত ১৩ ফেব্রুয়ারির সম্পাদকীয়তে আইএস তালেবানের বিরুদ্ধে ‘জিহাদি মহলে ব্যাপক ক্ষোভ’ এবং এই নিষেধাজ্ঞার কারণে তাদের সমর্থকদের মধ্যে ‘তাৎক্ষণিক’ প্রতিক্রিয়া দেখে সন্তোষ প্রকাশ করে। আইএস দাবি করে, এই সমালোচনার কারণে তালেবান একটি ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য হয়েছে।

আইএস তালেবানের এই ধরনের পদক্ষেপের জন্য তাদের দীর্ঘদিনের অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করেছে। তারা বলেছে, তালেবান তাদের ‘জিহাদি জজবা’ পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। তাদের ইমান নিয়ে গুরুতর সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। সম্পাদকীয়টির শিরোনাম ছিল ‘মূলের সঙ্গে সমস্যা, প্রান্তের সঙ্গে নয়!’ তালেবান দাবি করে তারা ‘গণতান্ত্রিক আমিরাত’ প্রতিষ্ঠা করেছে। আইএস সম্পাদকীয়তে তালেবানের এই দাবিকে উপহাস করে। আইএস দাবি করে, তালেবান অন্যান্য ‘মুরতাদ’ মুসলিম সরকারের পথ অনুসরণ করছে এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি গ্রহণ করছে। আইএস দাবি করে, আইএস সদস্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং আইএসের নিন্দামন্দ করে তালেবান এবং সিরিয়ার হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) উভয়ই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ‘স্বীকৃতি’ আদায় করেছে। আইএস এই নিষেধাজ্ঞাটিকে সালাফি-জিহাদি আকিদাকে দুর্বল করার একটি বৃহত্তর প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছে। তালেবান মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের ‘পরাজিত’ আকিদার (মতাদর্শ) দিকে ঝুঁকে পড়ছে বলে মনে করে আইএস।

যেসব বই নিষিদ্ধ করেছে তালেবান!

গত ১৭ জানুয়ারি, ইরানের কট্টরপন্থী সংবাদ সংস্থা তাসনিম-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, আফগানিস্তান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান আব্দুল হাকিম হাক্কানি তার ‘তাতিমাত আন-নিজাম’ বইতে মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের সমালোচনা করেছেন। তিনি ওয়াহাবিবাদকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ বর্ণনা করেছেন। বলেছেন, এই মতবাদ উত্থানের সময় মুসলমানদের রক্তপাতের দিকে চালিত করেছিল। আব্দুল হাকিম হাক্কানি তাঁর বইতে আরও বলেছেন, মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব ‘ইসলামি শিক্ষা’ থেকে বিচ্যুত হয়েছিলেন এবং ‘ধর্মীয় গ্রন্থের বিকৃত ব্যাখ্যা’ দিয়ে অজ্ঞদের বিভ্রান্ত করেছিলেন। তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা মোল্লা হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা আফগানিস্তান জুড়ে কর্তৃপক্ষকে ‘আকিদা থেকে বিচ্যুত’ বইগুলো বইয়ের দোকান, স্কুল লাইব্রেরি, বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন।

এই তালিকায় পড়েছে—দান্তের চতুর্দশ শতাব্দীর রূপক কাব্য ‘দ্য ডিভাইন কমেডি’, জোসেফ স্মিথের ‘দ্য বুক অব মরমন’, কাহলিল জিবরানের ‘দ্য প্রফেট’ এবং ইউভাল নোয়াহ হারারির সর্বাধিক বিক্রীত বই ‘সেপিয়েন্স’-এর মতো বই। বেশ কয়েকজন সুপরিচিত ইসলামিক পণ্ডিত ও ধর্মতাত্ত্বিক, সেই সঙ্গে ইরানি বুদ্ধিজীবী ও আফগান লেখকদের লেখাও কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। যেমন: মুহাম্মদ ইবনে আবদ আল-ওয়াহহাবের ‘কিতাব আত-তাওহিদ’; ইউসুফ আল-কারজাভির ‘দ্য ল’ফুল অ্যান্ড দ্য প্রোহিবিটেড ইন ইসলাম’; সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদীর ‘কোরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা’; সাইয়্যিদ কুতুবের ‘ইসলামে সামাজিক ন্যায়বিচার’; জামাল আদ-দিন আল-আফগানির জীবনী এবং লেখা; আবদুল্লাহ আযমের বই; আলী শরীয়তি, মোর্তেজা মোতাহারী এবং রামিন জাহানবেগলুর মতো অসংখ্য ইরানি বুদ্ধিজীবীদের লেখা। নারী অধিকার, জাতিসংঘের ফরমান, তালেবানের সমালোচকদের জীবনী, ধর্মনিরপেক্ষ সরকারি কাঠামো, এমনকি সাবেক আফগান প্রজাতন্ত্র নিয়ে লেখা বইগুলোও ‘বিপথগামী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ছাড়া শিয়া মতবাদ, মুনাফিকদের প্রশংসা, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, পশ্চিমা স্বাধীনতা, নারীদের সুরক্ষা, সাম্যবাদ, ইরানের প্রশংসা, কুসংস্কার, তালেবান-বিরোধী মতবাদ, জাতিসংঘের আইন, প্রজাতন্ত্রের বর্ণনা, সংগীতের প্রশংসা এবং ‘অবাঞ্ছিত বিষয়বস্তু’-সহ বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক বই নিষিদ্ধের তালিকায় রয়েছে।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

Update Time : 05:56:29 pm, Saturday, 20 September 2025
382 Time View

মওদূদীর বই বেছে বেছে নিষিদ্ধ করছে তালেবান: সালাফি হটাও’ পদক্ষেপ জোরদার আফগানিস্তান

Update Time : 05:56:29 pm, Saturday, 20 September 2025

আন্তর্জাতিক ডেস্ক­:
আফগানিস্তানে ক্ষমতাসীন তালেবান প্রশাসনের ‘শরিয়াহ বিরোধী’ বই নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কিছু সংবাদমাধ্যমে ‘শুধু নারীদের লেখা বই’ নিষিদ্ধের খবর এলেও প্রকৃতপক্ষে নিষিদ্ধ বইয়ের অধিকাংশই পুরুষদের লেখা। তালেবান মূলত সালাফি মতবাদ ঘনিষ্ঠ বই-পুস্তক নিষিদ্ধে গুরুত্ব দিচ্ছে। যদিও তারা সেটি স্পষ্ট করেনি। রীতিমতো কমিটি করে পর্যালোচনার ভিত্তিতে বইয়ের তালিকা করছে তালেবান।

তালেবানের এমন পদক্ষেপে খেপেছে ইসলামিক স্টেট (আইএস) গোষ্ঠী। এটি অনলাইনে সালাফি ও জিহাদিদের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। তারা এখন তালেবানকে অযোগ্য প্রমাণ করতে এবং সালাফিদের তালেবানের বিরুদ্ধে উসকে দিতে উঠেপড়ে লেগেছে।

নিষিদ্ধের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তালেবানের নজরে ওয়াহহাবিবাদী কিতাব। গত বছরের শেষ নাগাদ অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে ‘ওয়াহহাবিবাদী’ পুস্তক ‘কিতাব আত-তাওহিদ’ নিষিদ্ধ করে। এর প্রতিবাদে আইএস তাদের অনলাইন ম্যাগাজিন আন-নাবা-তে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। আইএস তালেবানের পদক্ষেপকে সেইসব ‘মুরতাদ’ বা ‘ধর্মত্যাগী’ আরব শাসকদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তুলনা করে, যাদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বকে সন্তুষ্ট করার এবং ইসলামকে দুর্বল করার অভিযোগ রয়েছে। আইএস দাবি করে, তালেবান কর্মকর্তারা বইটি নিষিদ্ধ করার কারণ হিসেবে বলেছে, এর কিছু অংশ আইএস অনুসারীরা ‘তাকফির’ (মুসলিমদের অতিমাত্রায় ধর্মচ্যুত করা) প্রচারে ব্যবহার করতে পারে।

গত বছরের নভেম্বরে তালেবান প্রায় ৪০০ বই নিষিদ্ধ করার একটি বৃহত্তর নীতির অংশ হিসেবে এই বইটি নিষিদ্ধ করলেও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের মাধ্যমে জানুয়ারিতে এটি সবার নজরে আসে। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত আইএস-এর অনলাইন পত্রিকা আন-নাবা-এর সম্পাদকীয়তে বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলোচনা করা হয়। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তালেবানের ধর্মীয় ত্রুটি খুঁজে বের করতে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আইএস। কিন্তু বই নিষিদ্ধের প্রতিক্রিয়া জানাতে তারা কেন এত দেরি করেছে সেটি আশ্চর্যের।তালেবানের ‘কিতাব আত-তাওহিদ’ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তটি গত বছরের নভেম্বরে আফগানিস্তানের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক ঘোষিত ৪০০টি বই নিষিদ্ধ করার একটি বৃহত্তর নীতির অংশ ছিল। তবে, এই নির্দিষ্ট সালাফি বইটি নিয়ে বিতর্ক জানুয়ারিতেই জনসমক্ষে আসে, যখন কিছু সাংবাদিক এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী লক্ষ্য করেন যে, বইটি নিষিদ্ধ তালিকার ৩৯ নম্বরে রয়েছে। বইটি নিষিদ্ধ করার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, এটি আফগানিস্তানের ‘জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে’ যায়।

তালেবানের সালাফি-বিরোধী পদক্ষেপ!

গত জানুয়ারিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইসলামপন্থী ও জিহাদি আলেম এবং নেটিজেন ১৮ শতকের সৌদি পণ্ডিত মুহাম্মদ বিন আবদ আল-ওয়াহহাবের লেখা ‘কিতাব আত-তাওহিদ’ নিষিদ্ধ করার প্রতিক্রিয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। মুহাম্মদ বিন আবদ আল-ওয়াহহাব (১৭০৩-৯২) ওয়াহহাবিবাদের মূল ব্যক্তিত্ব। এটি ইসলামের কঠোর, আক্ষরিক ব্যাখ্যার পক্ষের একটি চিন্তাধারা।

সালাফিবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ওয়াহহাবিবাদ প্রায়শই জিহাদি এবং সালাফি আলেমরা গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় চিন্তাধারা বলে মনে করেন। এই দলে আইএস-ও রয়েছে। আইএস-এর সদস্যরা আফগানিস্তানে তাদের তথাকথিত খোরাসান প্রদেশ শাখার (আইএসকেপি) মাধ্যমে সক্রিয়।অবশ্য, কিছু দেশের সরকার এবং সালাফি-বিরোধীরা প্রায়শই কাউকে ‘ওয়াহহাবি’ শব্দটি ‘চরমপন্থী’ বা ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করতে অবজ্ঞাসূচক অর্থে ব্যবহার করে।তালেবান এই প্রথম সালাফি ঘরানার কিতাব, চিন্তাধারা এবং পণ্ডিতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে এমন নয়। এসব পদক্ষেপের মূল কারণ স্পষ্টতই দেশে আইএস-এর চরমপন্থী মতাদর্শের বিস্তার রোধ করা। এই গ্রুপগুলো প্রায়শই তালেবানের বিরুদ্ধে উসকানি দেয়।

গত জানুয়ারিতে তালেবান পূর্ব কুনার প্রদেশে সালাফি মাদ্রাসাগুলো বন্ধ করে দেয়, এই মতাদর্শের অনুসারীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি সংস্থা থেকে বরখাস্ত করে এবং তাদের প্রভাব কমাতে বিদেশি আর্থিক সহায়তা বন্ধ করার পদক্ষেপ নেয়। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আফগান শাসকেরা সালাফিদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে শুরু করে এবং আফগানিস্তানের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে হানাফি মাজহাবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বইগুলো সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়। তালেবানের সদস্যরা হানাফি ইসলামের দেওবন্দী মাজহাবের অনুসারী। তারা সালাফিদের, বিশেষ করে আফগানিস্তানে আইএস-এর কর্মকাণ্ড এবং নিয়োগ প্রচেষ্টাকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখে।আরবি-ভাষী ইসলামপন্থীদের মধ্যে অনলাইন আলোচনা এবং সাম্প্রতিক আইএস পত্রিকার সম্পাদকীয় অনুসারে, কিছু তালেবান সদস্য ‘কিতাব আত-তাওহিদ’ নিষিদ্ধ করার কারণ হিসেবে বলেছেন, তাঁরা বই বা এর লেখকের বিরোধী নন। বরং তাঁদের উদ্বেগ হলো, এই লেখাটিকে বাড়াবাড়ি রকমের চরমপন্থা, বিশেষ করে ‘তাকফির’ (মুসলিমদের ধর্মচ্যুত করা) প্রচারে অপব্যবহার করা হয়েছে। এটি আইএস সমর্থকেরাই করেছে।

গণতান্ত্রিক আমিরাতের পথে যাত্রা!

গত ১৩ ফেব্রুয়ারির সম্পাদকীয়তে আইএস তালেবানের বিরুদ্ধে ‘জিহাদি মহলে ব্যাপক ক্ষোভ’ এবং এই নিষেধাজ্ঞার কারণে তাদের সমর্থকদের মধ্যে ‘তাৎক্ষণিক’ প্রতিক্রিয়া দেখে সন্তোষ প্রকাশ করে। আইএস দাবি করে, এই সমালোচনার কারণে তালেবান একটি ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য হয়েছে।

আইএস তালেবানের এই ধরনের পদক্ষেপের জন্য তাদের দীর্ঘদিনের অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করেছে। তারা বলেছে, তালেবান তাদের ‘জিহাদি জজবা’ পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। তাদের ইমান নিয়ে গুরুতর সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। সম্পাদকীয়টির শিরোনাম ছিল ‘মূলের সঙ্গে সমস্যা, প্রান্তের সঙ্গে নয়!’ তালেবান দাবি করে তারা ‘গণতান্ত্রিক আমিরাত’ প্রতিষ্ঠা করেছে। আইএস সম্পাদকীয়তে তালেবানের এই দাবিকে উপহাস করে। আইএস দাবি করে, তালেবান অন্যান্য ‘মুরতাদ’ মুসলিম সরকারের পথ অনুসরণ করছে এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি গ্রহণ করছে। আইএস দাবি করে, আইএস সদস্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং আইএসের নিন্দামন্দ করে তালেবান এবং সিরিয়ার হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) উভয়ই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ‘স্বীকৃতি’ আদায় করেছে। আইএস এই নিষেধাজ্ঞাটিকে সালাফি-জিহাদি আকিদাকে দুর্বল করার একটি বৃহত্তর প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছে। তালেবান মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের ‘পরাজিত’ আকিদার (মতাদর্শ) দিকে ঝুঁকে পড়ছে বলে মনে করে আইএস।

যেসব বই নিষিদ্ধ করেছে তালেবান!

গত ১৭ জানুয়ারি, ইরানের কট্টরপন্থী সংবাদ সংস্থা তাসনিম-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, আফগানিস্তান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান আব্দুল হাকিম হাক্কানি তার ‘তাতিমাত আন-নিজাম’ বইতে মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের সমালোচনা করেছেন। তিনি ওয়াহাবিবাদকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ বর্ণনা করেছেন। বলেছেন, এই মতবাদ উত্থানের সময় মুসলমানদের রক্তপাতের দিকে চালিত করেছিল। আব্দুল হাকিম হাক্কানি তাঁর বইতে আরও বলেছেন, মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব ‘ইসলামি শিক্ষা’ থেকে বিচ্যুত হয়েছিলেন এবং ‘ধর্মীয় গ্রন্থের বিকৃত ব্যাখ্যা’ দিয়ে অজ্ঞদের বিভ্রান্ত করেছিলেন। তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা মোল্লা হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা আফগানিস্তান জুড়ে কর্তৃপক্ষকে ‘আকিদা থেকে বিচ্যুত’ বইগুলো বইয়ের দোকান, স্কুল লাইব্রেরি, বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন।

এই তালিকায় পড়েছে—দান্তের চতুর্দশ শতাব্দীর রূপক কাব্য ‘দ্য ডিভাইন কমেডি’, জোসেফ স্মিথের ‘দ্য বুক অব মরমন’, কাহলিল জিবরানের ‘দ্য প্রফেট’ এবং ইউভাল নোয়াহ হারারির সর্বাধিক বিক্রীত বই ‘সেপিয়েন্স’-এর মতো বই। বেশ কয়েকজন সুপরিচিত ইসলামিক পণ্ডিত ও ধর্মতাত্ত্বিক, সেই সঙ্গে ইরানি বুদ্ধিজীবী ও আফগান লেখকদের লেখাও কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। যেমন: মুহাম্মদ ইবনে আবদ আল-ওয়াহহাবের ‘কিতাব আত-তাওহিদ’; ইউসুফ আল-কারজাভির ‘দ্য ল’ফুল অ্যান্ড দ্য প্রোহিবিটেড ইন ইসলাম’; সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদীর ‘কোরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা’; সাইয়্যিদ কুতুবের ‘ইসলামে সামাজিক ন্যায়বিচার’; জামাল আদ-দিন আল-আফগানির জীবনী এবং লেখা; আবদুল্লাহ আযমের বই; আলী শরীয়তি, মোর্তেজা মোতাহারী এবং রামিন জাহানবেগলুর মতো অসংখ্য ইরানি বুদ্ধিজীবীদের লেখা। নারী অধিকার, জাতিসংঘের ফরমান, তালেবানের সমালোচকদের জীবনী, ধর্মনিরপেক্ষ সরকারি কাঠামো, এমনকি সাবেক আফগান প্রজাতন্ত্র নিয়ে লেখা বইগুলোও ‘বিপথগামী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ছাড়া শিয়া মতবাদ, মুনাফিকদের প্রশংসা, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, পশ্চিমা স্বাধীনতা, নারীদের সুরক্ষা, সাম্যবাদ, ইরানের প্রশংসা, কুসংস্কার, তালেবান-বিরোধী মতবাদ, জাতিসংঘের আইন, প্রজাতন্ত্রের বর্ণনা, সংগীতের প্রশংসা এবং ‘অবাঞ্ছিত বিষয়বস্তু’-সহ বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক বই নিষিদ্ধের তালিকায় রয়েছে।