7:28 am, Thursday, 11 September 2025

কারা নিরাপত্তা’র ফাঁক গলে দেয়াল ঘেঁষে ‘বল’ আকারে মাদক প্রবেশ হচ্ছে দেদারছে!

দিগন্ত প্রতিদিন

picsart 25 09 11 03 17 32 037

 

নিজস্ব প্রতিবেদক:
মাদকের ব্যবসা কিংবা ব্যবহারের দায়ে যাকে নেয়া হচ্ছে কারাগারে সেই অপরাধীও সেখানে দেদারছে মাদক সেবনের সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু কোথায় পাচ্ছে মাদক? ‘নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা’র ফাঁক গলে কারাগারে কি করে পৌঁছাচ্ছে তা? খোঁদ কারারক্ষী ও এক শ্রেণির দুনীতিবাজ কর্মকর্তা কারাগারের ভেতরে মাদক পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।

কারাসূত্রে জানা গেছে, দেশের কারাবন্দীদের মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগই মাদকের মামলার আসামি। এদের মধ্যে বেশিরভাগই হাজতি। এদের কেউ মাদকাসক্ত, কেউ বিক্রেতা আবার কেউ ক্রেতা। এরা ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইনসহ বিভিন্ন মাদক মামলার আসামি। কারাগারে তাদের কাছে মাদক পৌঁছে মূলত কারারক্ষী ও কারা পুলিশের মাধ্যমে। সম্প্রতি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পাঠানো একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাদক ব্যবসায়ীরা সবসময় মরিয়া হয়ে থাকেন কিভাবে কারাগারের ভেতরে কারাবন্দি মাদকসেবীদের সরবরাহ করতে পারবে। নানা কায়দায় মাদকদ্রব্য কারাগারে পৌঁছে যায়। তার মধ্যে লুঙ্গি, শার্টের কলারে, জুতার ভেতরে, খাবারের সাথে এমন কি গলায় ঝুলানো তাবিজেও মাদক সরবরাহ করা হয়। কতিপয় দুনীতিবাজ কারা কর্মকর্তা ও কারারক্ষীদের মধ্যে ১’শর ওপরে কারাগারের ভেতরে মাদক সরবরাহের সাথে জড়িত। এদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। অর্থের বিনিময়ে মাদক ভেতরে সরবরাহ করে কারারক্ষীদের অনেকেই।

কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়া এক মাদক কারবারীর সাথে কথা বলে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, বাসা থেকে খাবার পাঠাতেন পিসির (জেলে টাকা পাঠানোর মাধ্যম) মাধ্যমে। ওইসব খাবার যেমন আপেল, কলা, গুড়, চিরা-মুড়ি, কমলার ভেতরে ইয়াবা ঢুকিয়ে দিত। যিনি দায়িত্বে থাকতেন তিনি টের পেতেন না। আর যদি কখনো টের পেতেন, টাকা দিলে আর মুখ খুলতেন না। শুধু বলতেন, তোমাকে পরিবার যে খাবার দিয়েছে তা অন্য কাউকে দিও না। অন্যরা জানলে সবার বিপদ হবে। কেননা কারাগারে মাদক নিষিদ্ধ।

কারাগারে ছিলেন মহসিন আলী, তিনি বর্তমানে ঢাকা রাজধানীতে অটোরিকশা চালান। তিনি বলেন, তার পাশে একজন ইয়াবা আসক্ত ছিল। তার সিগারেটের প্যাকেট যখন প্রবেশ করত, সেই প্যাকেটের দুই চারটি সিগারেটের তামাক বের করে ফেলে সেখানে ইয়াবা দিয়ে ভেতরে পাঠিয়ে দিত। রাতের বেলায় কয়েকজন মিলে সেই ইয়াবা সেবন করত। পরদিন সারাদিন ঘুমাত। কারাগারে এমনও আসামি আছে, যাদের নামে আসা মালপত্র কোনো প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ভেতরে প্রবেশ করানো হয়। বিনিময়ে আর্থিক সুবিধা ভোগ করে কিছু অসাধু কারারক্ষী। সংশ্লিষ্ট এক বিশেষ সূত্রে জানা যায়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাইসিকিউরিটি কাশিমপুর কারাগারের ভেতরে নিরাপত্তায় থাকা চারজন প্রিজন্স ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (পিআইইউ) সদস্যের বিরুদ্ধে ভয়াবহ মাদক জুয়া অবৈধভাবে মোবাইল ফোন বাণিজ্য সহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সদ্য মুক্তি পাওয়া এক কারাবন্দী বলেন, কারাগারের ভেতরে মাদক ব্যবসা, জুয়া বোর্ড, অবৈধ মোবাইল ফোন বাণিজ্য সহ নানা অবৈধ কর্মকাণ্ড চলছে প্রকাশ্যে। এসবের পেছনে আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছেন পিআইইউ সদস্য মেহেদী, মাহমুদুল হাসান, মোসারব ও রাসেল। তারা শুধু অবৈধ সিন্ডিকেটের নিরাপত্তাই দিচ্ছেন না, বরং চাঁদাবাজিতেও ব্যস্ত রয়েছেন, বিনিময়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা। কারাগারের নিরাপত্তা রক্ষার বদলে তারা পরিণত হয়েছেন অবৈধ বাণিজ্যের গডফাদারে। কারাগারের ভেতরে বিভিন্ন ভবনের নির্দিষ্ট কক্ষে পিআইইউ সদস্য মেহেদী, মাহমুদুল হাসান, মোসারব ও রাসেল এর ছত্রছায়ায় প্রতিদিন অর্থের বিনিময়ে বসছে অবৈধ জুয়ার আসর ও হচ্ছে মাদক বাণিজ্য। যেমন, হিমেল ভবনের ৩য় তলায় বন্দী সোহেল, মাসিক ৮ হাজার টাকা দিয়ে অবৈধ ভাবে বোর্ড পরিচালনা করেন। তমাল ভবনের ৬ষ্ঠ তলায় ইলিয়াস, দেন মাসিক ৬ হাজার টাকা। একই ভবনের ৪র্থ তলায় কাঞ্চন, দেন ৮ হাজার টাকা। গাজী ভবনের ৫ম তলায় কামালও মাসিক ৮ হাজার টাকা দিয়ে অবৈধভাবে জুয়ার বোর্ড পরিচালনা করছেন। পিআইইউ সদস্য মেহেদী, মাহমুদুল হাসান, মোসারব ও রাসেল কে নিয়মিত মোটা অংকের অর্থ দিয়ে এসব জুয়ার বোর্ড ও মাদক ব্যবসা চালাচ্ছেন কারাবন্দী মাদক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট।

আলোচিত নারায়ণগঞ্জ সাত খুন মামলার আসামি নূর হোসেন, কারাগারে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন, মাসিক এক লক্ষ টাকা দিয়ে নির্বিঘ্নে অবৈধভাবে মোবাইল ফোন দিয়ে কারাগার থেকে চালিয়ে যাচ্ছেন তার বাহিরের রাজত্ব। একইভাবে আফজাল নামের এক কারা বন্দী অবৈধ মোবাইল ফোন চালানো বাবদ মাসিক ৪০ হাজার টাকা তাদেরকে দেন। হলমার্ক কেলেঙ্কারির তুষার আহমেদ দেন মাসিক ৮০ হাজার টাকা। এমপি আনার হত্যা মামলার আসামি শিমুল ভূঁইয়া মাসিক ৫০ হাজার টাকা প্রদান করেন। এই প্রভাবশালী বন্দীরা নিয়মিত এসব অর্থ দিয়ে মেহেদী, মাহমুদুল হাসান, মোসারব ও রাসেল গ্যাংদের ছত্রছায়ায় প্রশাসনের চোখের সামনেই বিলাসবহুল জীবন যাপন সহ কারাগার থেকে বাহিরে তাদের সন্ত্রাসী রাজত্ব কায়েম করে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, কারাবন্দী মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কারা দেয়ালের বাহির থেকে কারাগারের ভেতরে ‘বল’ আকারে মাদক ছুঁড়ে প্রবেশ করাচ্ছেন। এরপর কারাগারের ভেতরে থাকা তাদের মাদকের সিন্ডিকেট সদস্যদের দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে মাদকের ভয়াবহ রাজত্ব। এসব মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এই চার পিআইইউ সদস্য মেহেদী, মাহমুদুল হাসান, মোসারব ও রাসেল। এবং তারা মাদক বিক্রি লাভের অংশ থেকেও প্রতিমাসে তিন থেকে চার লক্ষ টাকা ঘুষ ভাগাভাগি করে নেন মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। শুধু ভেতরেই নয়, কারাবন্দীর জামিনে মুক্তি প্রক্রিয়াতেও ঘোষবাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। কারামুক্তি পাওয়া বন্দীরা জনপ্রতি ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা দিতে হয় এই পিআইইউ সদস্যদের। তাদের কে টাকা না দিলে জামিনে ‘ক্লিয়ারেন্স’ মেলে না। কারা দায়িত্ব পালনের বদলে অবৈধ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে হাইসিকিউরিটি কারাগার নিরাপত্তা মারাত্মক ঝুঁকির মুখে ফেলছেন এই পিআইইউ চার সদস্য।

কারাগার একাধিক সূত্র ও কারা অধিদফতরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেন, কারাগারে ভেতর মাদক ব্যবসা ও অনিয়ম দুর্নীতি সিন্ডিকেটের কার্যক্রমে যদি আমরা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করি তাহলে আমারদের বিরুদ্ধে এই পিআইইউ সদস্যরা বিভিন্নভাবে মিথ্যা রিপোর্ট তৈরি করে হয়রানি করেন। অভিযুক্ত এই চার পিআইইউ সদস্যের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার যেকোনো সময় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কারাগারে মাদকের বিস্তার ও সরবরাহ প্রসঙ্গে একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, কড়া নিরাপত্তার মধ্যেও কারাগারের ভেতরে মাদক ঢুকছে। মাদক সরবরাহ বন্ধে প্রবেশ পথে লাগেজ ও বডি স্ক্যানার বসানো হয়েছে। এর পরেও মাদক সরবরাহ বন্ধ হচ্ছে না। বন্দিরা কারাগারে মাদক পাচ্ছে। লুঙ্গি ও শার্টের সেলাইয়ের ভাঁজের ভেতরে, শুকনো মরিচ, পেঁয়াজ, টুথপেস্ট, আপেল ও সিগারেটের প্যাকেটের ভেতরে যাচ্ছে ইয়াবা। এছাড়া খাবারের ভেতরেও গাঁজাসহ নানা ধরনের মাদক কারাগারে যাচ্ছে। আর এসব কাজে কারারক্ষীদের একটা অংশ সহায়তা করছে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কারারক্ষীদের অনেকে মাদক ভেতরে প্রবেশে সহায়তা করে থাকেন। তাদের চিহ্নিত করে গত এক বছরে ২৫ জনকে শাস্তির আওতায় আনা হয়। এর মধ্যে ৩ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বাকিদের বিচার চলছে।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

Update Time : 09:42:54 pm, Wednesday, 10 September 2025
21 Time View

কারা নিরাপত্তা’র ফাঁক গলে দেয়াল ঘেঁষে ‘বল’ আকারে মাদক প্রবেশ হচ্ছে দেদারছে!

Update Time : 09:42:54 pm, Wednesday, 10 September 2025

 

নিজস্ব প্রতিবেদক:
মাদকের ব্যবসা কিংবা ব্যবহারের দায়ে যাকে নেয়া হচ্ছে কারাগারে সেই অপরাধীও সেখানে দেদারছে মাদক সেবনের সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু কোথায় পাচ্ছে মাদক? ‘নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা’র ফাঁক গলে কারাগারে কি করে পৌঁছাচ্ছে তা? খোঁদ কারারক্ষী ও এক শ্রেণির দুনীতিবাজ কর্মকর্তা কারাগারের ভেতরে মাদক পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।

কারাসূত্রে জানা গেছে, দেশের কারাবন্দীদের মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগই মাদকের মামলার আসামি। এদের মধ্যে বেশিরভাগই হাজতি। এদের কেউ মাদকাসক্ত, কেউ বিক্রেতা আবার কেউ ক্রেতা। এরা ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইনসহ বিভিন্ন মাদক মামলার আসামি। কারাগারে তাদের কাছে মাদক পৌঁছে মূলত কারারক্ষী ও কারা পুলিশের মাধ্যমে। সম্প্রতি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পাঠানো একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাদক ব্যবসায়ীরা সবসময় মরিয়া হয়ে থাকেন কিভাবে কারাগারের ভেতরে কারাবন্দি মাদকসেবীদের সরবরাহ করতে পারবে। নানা কায়দায় মাদকদ্রব্য কারাগারে পৌঁছে যায়। তার মধ্যে লুঙ্গি, শার্টের কলারে, জুতার ভেতরে, খাবারের সাথে এমন কি গলায় ঝুলানো তাবিজেও মাদক সরবরাহ করা হয়। কতিপয় দুনীতিবাজ কারা কর্মকর্তা ও কারারক্ষীদের মধ্যে ১’শর ওপরে কারাগারের ভেতরে মাদক সরবরাহের সাথে জড়িত। এদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। অর্থের বিনিময়ে মাদক ভেতরে সরবরাহ করে কারারক্ষীদের অনেকেই।

কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়া এক মাদক কারবারীর সাথে কথা বলে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, বাসা থেকে খাবার পাঠাতেন পিসির (জেলে টাকা পাঠানোর মাধ্যম) মাধ্যমে। ওইসব খাবার যেমন আপেল, কলা, গুড়, চিরা-মুড়ি, কমলার ভেতরে ইয়াবা ঢুকিয়ে দিত। যিনি দায়িত্বে থাকতেন তিনি টের পেতেন না। আর যদি কখনো টের পেতেন, টাকা দিলে আর মুখ খুলতেন না। শুধু বলতেন, তোমাকে পরিবার যে খাবার দিয়েছে তা অন্য কাউকে দিও না। অন্যরা জানলে সবার বিপদ হবে। কেননা কারাগারে মাদক নিষিদ্ধ।

কারাগারে ছিলেন মহসিন আলী, তিনি বর্তমানে ঢাকা রাজধানীতে অটোরিকশা চালান। তিনি বলেন, তার পাশে একজন ইয়াবা আসক্ত ছিল। তার সিগারেটের প্যাকেট যখন প্রবেশ করত, সেই প্যাকেটের দুই চারটি সিগারেটের তামাক বের করে ফেলে সেখানে ইয়াবা দিয়ে ভেতরে পাঠিয়ে দিত। রাতের বেলায় কয়েকজন মিলে সেই ইয়াবা সেবন করত। পরদিন সারাদিন ঘুমাত। কারাগারে এমনও আসামি আছে, যাদের নামে আসা মালপত্র কোনো প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ভেতরে প্রবেশ করানো হয়। বিনিময়ে আর্থিক সুবিধা ভোগ করে কিছু অসাধু কারারক্ষী। সংশ্লিষ্ট এক বিশেষ সূত্রে জানা যায়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাইসিকিউরিটি কাশিমপুর কারাগারের ভেতরে নিরাপত্তায় থাকা চারজন প্রিজন্স ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (পিআইইউ) সদস্যের বিরুদ্ধে ভয়াবহ মাদক জুয়া অবৈধভাবে মোবাইল ফোন বাণিজ্য সহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সদ্য মুক্তি পাওয়া এক কারাবন্দী বলেন, কারাগারের ভেতরে মাদক ব্যবসা, জুয়া বোর্ড, অবৈধ মোবাইল ফোন বাণিজ্য সহ নানা অবৈধ কর্মকাণ্ড চলছে প্রকাশ্যে। এসবের পেছনে আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছেন পিআইইউ সদস্য মেহেদী, মাহমুদুল হাসান, মোসারব ও রাসেল। তারা শুধু অবৈধ সিন্ডিকেটের নিরাপত্তাই দিচ্ছেন না, বরং চাঁদাবাজিতেও ব্যস্ত রয়েছেন, বিনিময়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা। কারাগারের নিরাপত্তা রক্ষার বদলে তারা পরিণত হয়েছেন অবৈধ বাণিজ্যের গডফাদারে। কারাগারের ভেতরে বিভিন্ন ভবনের নির্দিষ্ট কক্ষে পিআইইউ সদস্য মেহেদী, মাহমুদুল হাসান, মোসারব ও রাসেল এর ছত্রছায়ায় প্রতিদিন অর্থের বিনিময়ে বসছে অবৈধ জুয়ার আসর ও হচ্ছে মাদক বাণিজ্য। যেমন, হিমেল ভবনের ৩য় তলায় বন্দী সোহেল, মাসিক ৮ হাজার টাকা দিয়ে অবৈধ ভাবে বোর্ড পরিচালনা করেন। তমাল ভবনের ৬ষ্ঠ তলায় ইলিয়াস, দেন মাসিক ৬ হাজার টাকা। একই ভবনের ৪র্থ তলায় কাঞ্চন, দেন ৮ হাজার টাকা। গাজী ভবনের ৫ম তলায় কামালও মাসিক ৮ হাজার টাকা দিয়ে অবৈধভাবে জুয়ার বোর্ড পরিচালনা করছেন। পিআইইউ সদস্য মেহেদী, মাহমুদুল হাসান, মোসারব ও রাসেল কে নিয়মিত মোটা অংকের অর্থ দিয়ে এসব জুয়ার বোর্ড ও মাদক ব্যবসা চালাচ্ছেন কারাবন্দী মাদক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট।

আলোচিত নারায়ণগঞ্জ সাত খুন মামলার আসামি নূর হোসেন, কারাগারে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন, মাসিক এক লক্ষ টাকা দিয়ে নির্বিঘ্নে অবৈধভাবে মোবাইল ফোন দিয়ে কারাগার থেকে চালিয়ে যাচ্ছেন তার বাহিরের রাজত্ব। একইভাবে আফজাল নামের এক কারা বন্দী অবৈধ মোবাইল ফোন চালানো বাবদ মাসিক ৪০ হাজার টাকা তাদেরকে দেন। হলমার্ক কেলেঙ্কারির তুষার আহমেদ দেন মাসিক ৮০ হাজার টাকা। এমপি আনার হত্যা মামলার আসামি শিমুল ভূঁইয়া মাসিক ৫০ হাজার টাকা প্রদান করেন। এই প্রভাবশালী বন্দীরা নিয়মিত এসব অর্থ দিয়ে মেহেদী, মাহমুদুল হাসান, মোসারব ও রাসেল গ্যাংদের ছত্রছায়ায় প্রশাসনের চোখের সামনেই বিলাসবহুল জীবন যাপন সহ কারাগার থেকে বাহিরে তাদের সন্ত্রাসী রাজত্ব কায়েম করে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, কারাবন্দী মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কারা দেয়ালের বাহির থেকে কারাগারের ভেতরে ‘বল’ আকারে মাদক ছুঁড়ে প্রবেশ করাচ্ছেন। এরপর কারাগারের ভেতরে থাকা তাদের মাদকের সিন্ডিকেট সদস্যদের দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে মাদকের ভয়াবহ রাজত্ব। এসব মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এই চার পিআইইউ সদস্য মেহেদী, মাহমুদুল হাসান, মোসারব ও রাসেল। এবং তারা মাদক বিক্রি লাভের অংশ থেকেও প্রতিমাসে তিন থেকে চার লক্ষ টাকা ঘুষ ভাগাভাগি করে নেন মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। শুধু ভেতরেই নয়, কারাবন্দীর জামিনে মুক্তি প্রক্রিয়াতেও ঘোষবাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। কারামুক্তি পাওয়া বন্দীরা জনপ্রতি ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা দিতে হয় এই পিআইইউ সদস্যদের। তাদের কে টাকা না দিলে জামিনে ‘ক্লিয়ারেন্স’ মেলে না। কারা দায়িত্ব পালনের বদলে অবৈধ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে হাইসিকিউরিটি কারাগার নিরাপত্তা মারাত্মক ঝুঁকির মুখে ফেলছেন এই পিআইইউ চার সদস্য।

কারাগার একাধিক সূত্র ও কারা অধিদফতরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেন, কারাগারে ভেতর মাদক ব্যবসা ও অনিয়ম দুর্নীতি সিন্ডিকেটের কার্যক্রমে যদি আমরা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করি তাহলে আমারদের বিরুদ্ধে এই পিআইইউ সদস্যরা বিভিন্নভাবে মিথ্যা রিপোর্ট তৈরি করে হয়রানি করেন। অভিযুক্ত এই চার পিআইইউ সদস্যের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার যেকোনো সময় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কারাগারে মাদকের বিস্তার ও সরবরাহ প্রসঙ্গে একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, কড়া নিরাপত্তার মধ্যেও কারাগারের ভেতরে মাদক ঢুকছে। মাদক সরবরাহ বন্ধে প্রবেশ পথে লাগেজ ও বডি স্ক্যানার বসানো হয়েছে। এর পরেও মাদক সরবরাহ বন্ধ হচ্ছে না। বন্দিরা কারাগারে মাদক পাচ্ছে। লুঙ্গি ও শার্টের সেলাইয়ের ভাঁজের ভেতরে, শুকনো মরিচ, পেঁয়াজ, টুথপেস্ট, আপেল ও সিগারেটের প্যাকেটের ভেতরে যাচ্ছে ইয়াবা। এছাড়া খাবারের ভেতরেও গাঁজাসহ নানা ধরনের মাদক কারাগারে যাচ্ছে। আর এসব কাজে কারারক্ষীদের একটা অংশ সহায়তা করছে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কারারক্ষীদের অনেকে মাদক ভেতরে প্রবেশে সহায়তা করে থাকেন। তাদের চিহ্নিত করে গত এক বছরে ২৫ জনকে শাস্তির আওতায় আনা হয়। এর মধ্যে ৩ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বাকিদের বিচার চলছে।