1:57 am, Tuesday, 9 September 2025

এই কঠোর বার্তাকেও তোয়াক্কা করছেন না ‘মব ত্রাস’ সৃষ্টিকারীরা

1756640487087

 

ডেস্ক রিপোর্ট:
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একাধিক উপদেষ্টা, সেনাবাহিনী প্রধানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ‘মব ত্রাসের’ বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিলেও গোটা দেশ যেন আজ ‘মব কালচার’ আতঙ্কে। সরকারের শীর্ষ মহলের এই কঠোর বার্তাকেও তোয়াক্কা করছেন না ‘মব ত্রাস’ সৃষ্টিকারীরা। ‘মব ত্রাস’ নিয়ে সরকারের শীর্ষ মহল থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে- এমনটাই ভাবছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ বিশিষ্টজনরা। তাদের ভাবনা, ‘মব’ সৃষ্টি বা জনতার হাতে আইন তুলে নেওয়ার ঘটনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর দৃষ্টান্ত।

রাজনৈতিক দলগুলো মব সৃষ্টির বিপক্ষে থাকলেও কোনো অদৃশ্য শক্তির ঈশারায় কারা দেশকে অস্থিরতায় ঠেলে দিচ্ছে। মব সৃষ্টি করে কোনো ব্যক্তিকে যে কোনো বিষয়ে সন্দেহ হলেই মেরে ফেলা-একটা বিচারহীনতার সংস্কৃতি। রাজনৈতিক প্রশ্রয়, বিচার ব্যবস্থার জটিলতা ও সামাজিক শিক্ষা ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশই এই ‘মব সন্ত্রাস’। যা দেশের সকল নাগরিকের মধ্যে গভীর উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে। যা দেশের জন্য মোটেই কল্যাণকর ও শুভকর নয়।

বিশিষ্টজনরা বলছে, গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচার হাসিনা সরকার দেশ থেকে পলায়নের পর গোটা জাতি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল। সে আশার গুঁড়েবালি মব কালচার বা মব ত্রাসের মাধ্যমে। যদিও এই মব ত্রাসের পৃষ্টাপোষক ফ্যাসিস্ট হাসিনা তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য মব তৈরি করেছিল। তৎকালীন সময়ে শেখ হাসিনা নিজের হাতিয়ার হিসেবে শাহবাগে মব সৃষ্টি করে রেখেছিলেন, তার বিপক্ষে যাতে কেউ কোনো কথা বলতে না পারে। স্বৈরাচার হাসিনা পতনের পর গোটা দেশে প্রবলভাবে বেড়ে গেছে মব কালচার।

বিশিষ্টজনদের মতে, কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে বা তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থাকলে দেশের প্রচলিত আইনে তার বিচার করতে হবে। বিচার ব্যতিরেকে এভাবে মব সৃষ্টির ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকলে এটি ভবিষ্যতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।

প্রসঙ্গত, কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরা হলো-শুক্রবার মব ত্রাসের শিকার হয়েছে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নূরুল হক নুরু। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফজলুল হক মুসলিম হলে তোফাজ্জল নামে এক মানসিক ভারসাম্যহীন তরুণকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ঘটেছে। মুরাদনগরের কড়ইবাড়ি গ্রামের মা ও দুই সন্তানকে মোবাইল চুরি ও মাদক কারবারির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা। মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে সোহাগ হত্যাকাণ্ড মব ত্রাসের শিকার। কেবল এই ঘটনাই নয়, গাজীপুরের হৃদয়, লালমনিরহাটের পরেশ শীল, কিংবা রাজধানীর আল আমীনের মতো বহু মানুষ শিকার হয়েছেন এই মব সন্ত্রাসে।

গত একবছরে সারে তিন শত ঘটনায় প্রায় পৌনে দুইশত লোক নিহত হয়েছে মব ত্রাসের শিকার হয়ে। অপরাধের বিচার আইন অনুযায়ী নয়, বরং রাস্তায়, জনতার হাতেই সম্পন্ন হচ্ছে। ঘটনা শুধু একক ঘটনা নয়- এটি প্রতিফলন সামাজিক অসহিষ্ণুতা ও ভঙ্গুর বিচার ব্যবস্থার। এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, অনেক সাধারণ মানুষ আজ নিজেদের বিচারক মনে করে। সন্দেহ হলেই শুরু হয় পেটানো, ভিডিও তোলা, আর পুলিশের কাছে নয়-‘জনতার রায়েই’ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর। এই প্রবণতা দেশের জন্য খবুই ভয়ংকর।

মব ত্রাস প্রসঙ্গে বিএনপি বলছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দলবদ্ধভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা বেড়েছে। উচ্ছৃঙ্খল জনতা মব সৃষ্টির করে নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে সহিংসতা করছে, এরা কারা সরকার কেন এদেরকে চিহিৃত করছে না। মবের এই সংস্কৃতি অত্যন্ত উদ্বেগের। সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে তো মনে হচ্ছে না। দেখেন, ছাত্ররা যমুনার সামনে গিয়ে বা শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে এক ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিচ্ছে। সরকার দ্রুত বৈঠক ডেকে তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে সরকারের উপরও সরকার আছে। এভাবে চললে আপনি আইনের শাসন বাস্তবায়ন করবেন কীভাবে?

এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গতকাল বলেছেন, দেশকে অবশ্যই বেআইনি মবের শাসন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের উন্নতির জন্য মবের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সতর্কতা বজায় রাখা উচিত।

বিএনপির এই শীর্ষ নেতা বলেন, আমরা বর্তমানে একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর গণতান্ত্রিক উত্তরণের সময় অতিক্রম করছি, যার প্রথম ধাপ হলো জাতীয় নির্বাচন। আমাদের সম্মিলিতভাবে নিশ্চিত করতে হবে যে, আজ যা ঘটেছে, তেমন অস্থিতিশীলতামূলক ঘটনা যেন আর ছড়িয়ে পড়তে না পারে এবং আমাদের গণতন্ত্রের পথে অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত না করে। বিএনপি এবং মিত্র গণতন্ত্রপন্থি অংশীদারদের অবশ্যই সংযম ও সহনশীলতা বজায় রাখতে হবে।

গত বছরের গণঅভ্যুত্থানের প্রকৃত চেতনাকে অবশ্যই জয়ী হতে হবে। দেশকে অবশ্যই বেআইনি মবের শাসন এবং বর্তমান অস্থিরতার শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, যদি আমরা বাংলাদেশের অগ্রগতি দেখতে চাই, তাহলে আমাদের মবের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সতর্কতা বজায় রাখা উচিত।

এ প্রসঙ্গে শুক্রবার গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা এমিরেটাস সভাপতি বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেন, দেশে সন্ত্রাস, সংঘর্ষ, খুনোখুনি ও মব সংস্কৃতির এক নতুন প্রেক্ষাপট বিরাজ করছে, এই অশুভ শক্তিকে দমন করতে সরকার ব্যর্থ হলে দেশে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।

ড. কামাল হোসেন বলেন, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে দেশে গণতন্ত্রহীনতা ও নিপীড়নমূলক এক স্বৈরশাসনের কবলে পড়ে আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, ভোটাধিকার, মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ অবাধে লুটপাট, অর্থপাচার, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও দলীয়করণের মাধ্যমে দেশ শাসনে ভয়াবহ সংকট ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়।

২৪-এর জুলাই সংঘটিত ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বৈষম্যহীন সমাজ, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার এক নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কোনো অশুভ শক্তি বা ষড়যন্ত্র যেন এই রক্তস্নাত বিজয় ও মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাধা সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

তিনি আরও বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই লক্ষ করা যাচ্ছে, একটি অশুভ শক্তি বিগত আমলের মতোই সর্বত্র চাঁদাবাজি, দখলবাজি, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাস, সংঘর্ষ, খুনোখুনি ও মব সংস্কৃতির এক নতুন প্রেক্ষাপট বিরাজ করছে। এই অশুভ শক্তিকে দমন করতে সরকার ব্যর্থ হলে দেশে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে, যা কারো কাম্য নয়।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবীর রিজভী বলেন, মব কালচার এখন দেশে ভয় ও আতঙ্কের নতুন উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ একজন চুরির অভিযোগ করলে উচ্ছৃঙ্খল জনতা মিলে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে, পিটিয়ে মারছে- এটা সভ্য সমাজে কল্পনাও করা যায় না। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর মব কালচার এত বেশি তীব্র আকারধারণ করল কেন? এখানে প্রশাসনিক ব্যবস্থা কোথায়? এটা তো মানুষ আজ জানতে চায়।

তিনি বলেন, মব কালচারের কারণে দেশে আজ স্বামী-স্ত্রী-সন্তানসহ হত্যা করা হচ্ছে। প্রতিদিন বীভৎস হত্যাকাণ্ড ঘটছে। এটা তো অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা করে না মানুষ।

বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় সাবেক চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর যে ‘মব কালচার’ তীব্র আকারে দেখা যাচ্ছে তা মোকাবিলায় সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

সরকারের দুর্বলতা কোথায় যে, ‘মব কালচার’ প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। সাবেক এই চিফ হুইপ বলেন, সবকিছুর ঊর্ধ্বে বড় প্রাপ্তি যেন-মব কালচার। যে কাউকে, যেকোনো জায়গায়, মেরে মাটিতে শুইয়ে ফেলা এখন আর কোনো বিষয় নয়। কেবল একটা ট্যাগ দিয়ে দিলেই হলো। কেউ কিছু বলবে না। পুলিশ চেয়ে চেয়ে দেখবে, কিন্তু কিছু বলার সাহস পাবে না।

তিনি বলেন, কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে বা তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থাকলে দেশের প্রচলিত আইনে তার বিচার হবে। বিচার ব্যতিরেকে ‘মব’ সৃষ্টি বা জনতার হাতে আইন তুলে নিয়ে হত্যার ঘটনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর দৃষ্টান্ত। ‘মব’ সৃষ্টির এ ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথকে আরও জটিল করে তুলবে।

তিনি আরও বলেন, আইনের শাসনের পরিবর্তে ‘মব কালচার’কে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার প্রচ্ছন্ন সংকেত দেয়। এ ঘটনায় সরকারের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। যারা ‘মব সৃষ্টি করে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

Update Time : 11:42:45 am, Sunday, 31 August 2025
85 Time View

এই কঠোর বার্তাকেও তোয়াক্কা করছেন না ‘মব ত্রাস’ সৃষ্টিকারীরা

Update Time : 11:42:45 am, Sunday, 31 August 2025

 

ডেস্ক রিপোর্ট:
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একাধিক উপদেষ্টা, সেনাবাহিনী প্রধানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ‘মব ত্রাসের’ বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিলেও গোটা দেশ যেন আজ ‘মব কালচার’ আতঙ্কে। সরকারের শীর্ষ মহলের এই কঠোর বার্তাকেও তোয়াক্কা করছেন না ‘মব ত্রাস’ সৃষ্টিকারীরা। ‘মব ত্রাস’ নিয়ে সরকারের শীর্ষ মহল থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে- এমনটাই ভাবছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ বিশিষ্টজনরা। তাদের ভাবনা, ‘মব’ সৃষ্টি বা জনতার হাতে আইন তুলে নেওয়ার ঘটনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর দৃষ্টান্ত।

রাজনৈতিক দলগুলো মব সৃষ্টির বিপক্ষে থাকলেও কোনো অদৃশ্য শক্তির ঈশারায় কারা দেশকে অস্থিরতায় ঠেলে দিচ্ছে। মব সৃষ্টি করে কোনো ব্যক্তিকে যে কোনো বিষয়ে সন্দেহ হলেই মেরে ফেলা-একটা বিচারহীনতার সংস্কৃতি। রাজনৈতিক প্রশ্রয়, বিচার ব্যবস্থার জটিলতা ও সামাজিক শিক্ষা ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশই এই ‘মব সন্ত্রাস’। যা দেশের সকল নাগরিকের মধ্যে গভীর উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে। যা দেশের জন্য মোটেই কল্যাণকর ও শুভকর নয়।

বিশিষ্টজনরা বলছে, গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচার হাসিনা সরকার দেশ থেকে পলায়নের পর গোটা জাতি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল। সে আশার গুঁড়েবালি মব কালচার বা মব ত্রাসের মাধ্যমে। যদিও এই মব ত্রাসের পৃষ্টাপোষক ফ্যাসিস্ট হাসিনা তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য মব তৈরি করেছিল। তৎকালীন সময়ে শেখ হাসিনা নিজের হাতিয়ার হিসেবে শাহবাগে মব সৃষ্টি করে রেখেছিলেন, তার বিপক্ষে যাতে কেউ কোনো কথা বলতে না পারে। স্বৈরাচার হাসিনা পতনের পর গোটা দেশে প্রবলভাবে বেড়ে গেছে মব কালচার।

বিশিষ্টজনদের মতে, কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে বা তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থাকলে দেশের প্রচলিত আইনে তার বিচার করতে হবে। বিচার ব্যতিরেকে এভাবে মব সৃষ্টির ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকলে এটি ভবিষ্যতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।

প্রসঙ্গত, কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরা হলো-শুক্রবার মব ত্রাসের শিকার হয়েছে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নূরুল হক নুরু। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফজলুল হক মুসলিম হলে তোফাজ্জল নামে এক মানসিক ভারসাম্যহীন তরুণকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ঘটেছে। মুরাদনগরের কড়ইবাড়ি গ্রামের মা ও দুই সন্তানকে মোবাইল চুরি ও মাদক কারবারির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা। মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে সোহাগ হত্যাকাণ্ড মব ত্রাসের শিকার। কেবল এই ঘটনাই নয়, গাজীপুরের হৃদয়, লালমনিরহাটের পরেশ শীল, কিংবা রাজধানীর আল আমীনের মতো বহু মানুষ শিকার হয়েছেন এই মব সন্ত্রাসে।

গত একবছরে সারে তিন শত ঘটনায় প্রায় পৌনে দুইশত লোক নিহত হয়েছে মব ত্রাসের শিকার হয়ে। অপরাধের বিচার আইন অনুযায়ী নয়, বরং রাস্তায়, জনতার হাতেই সম্পন্ন হচ্ছে। ঘটনা শুধু একক ঘটনা নয়- এটি প্রতিফলন সামাজিক অসহিষ্ণুতা ও ভঙ্গুর বিচার ব্যবস্থার। এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, অনেক সাধারণ মানুষ আজ নিজেদের বিচারক মনে করে। সন্দেহ হলেই শুরু হয় পেটানো, ভিডিও তোলা, আর পুলিশের কাছে নয়-‘জনতার রায়েই’ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর। এই প্রবণতা দেশের জন্য খবুই ভয়ংকর।

মব ত্রাস প্রসঙ্গে বিএনপি বলছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দলবদ্ধভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা বেড়েছে। উচ্ছৃঙ্খল জনতা মব সৃষ্টির করে নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে সহিংসতা করছে, এরা কারা সরকার কেন এদেরকে চিহিৃত করছে না। মবের এই সংস্কৃতি অত্যন্ত উদ্বেগের। সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে তো মনে হচ্ছে না। দেখেন, ছাত্ররা যমুনার সামনে গিয়ে বা শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে এক ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিচ্ছে। সরকার দ্রুত বৈঠক ডেকে তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে সরকারের উপরও সরকার আছে। এভাবে চললে আপনি আইনের শাসন বাস্তবায়ন করবেন কীভাবে?

এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গতকাল বলেছেন, দেশকে অবশ্যই বেআইনি মবের শাসন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের উন্নতির জন্য মবের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সতর্কতা বজায় রাখা উচিত।

বিএনপির এই শীর্ষ নেতা বলেন, আমরা বর্তমানে একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর গণতান্ত্রিক উত্তরণের সময় অতিক্রম করছি, যার প্রথম ধাপ হলো জাতীয় নির্বাচন। আমাদের সম্মিলিতভাবে নিশ্চিত করতে হবে যে, আজ যা ঘটেছে, তেমন অস্থিতিশীলতামূলক ঘটনা যেন আর ছড়িয়ে পড়তে না পারে এবং আমাদের গণতন্ত্রের পথে অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত না করে। বিএনপি এবং মিত্র গণতন্ত্রপন্থি অংশীদারদের অবশ্যই সংযম ও সহনশীলতা বজায় রাখতে হবে।

গত বছরের গণঅভ্যুত্থানের প্রকৃত চেতনাকে অবশ্যই জয়ী হতে হবে। দেশকে অবশ্যই বেআইনি মবের শাসন এবং বর্তমান অস্থিরতার শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, যদি আমরা বাংলাদেশের অগ্রগতি দেখতে চাই, তাহলে আমাদের মবের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সতর্কতা বজায় রাখা উচিত।

এ প্রসঙ্গে শুক্রবার গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা এমিরেটাস সভাপতি বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেন, দেশে সন্ত্রাস, সংঘর্ষ, খুনোখুনি ও মব সংস্কৃতির এক নতুন প্রেক্ষাপট বিরাজ করছে, এই অশুভ শক্তিকে দমন করতে সরকার ব্যর্থ হলে দেশে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।

ড. কামাল হোসেন বলেন, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে দেশে গণতন্ত্রহীনতা ও নিপীড়নমূলক এক স্বৈরশাসনের কবলে পড়ে আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, ভোটাধিকার, মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ অবাধে লুটপাট, অর্থপাচার, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও দলীয়করণের মাধ্যমে দেশ শাসনে ভয়াবহ সংকট ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়।

২৪-এর জুলাই সংঘটিত ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বৈষম্যহীন সমাজ, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার এক নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কোনো অশুভ শক্তি বা ষড়যন্ত্র যেন এই রক্তস্নাত বিজয় ও মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাধা সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

তিনি আরও বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই লক্ষ করা যাচ্ছে, একটি অশুভ শক্তি বিগত আমলের মতোই সর্বত্র চাঁদাবাজি, দখলবাজি, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাস, সংঘর্ষ, খুনোখুনি ও মব সংস্কৃতির এক নতুন প্রেক্ষাপট বিরাজ করছে। এই অশুভ শক্তিকে দমন করতে সরকার ব্যর্থ হলে দেশে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে, যা কারো কাম্য নয়।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবীর রিজভী বলেন, মব কালচার এখন দেশে ভয় ও আতঙ্কের নতুন উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ একজন চুরির অভিযোগ করলে উচ্ছৃঙ্খল জনতা মিলে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে, পিটিয়ে মারছে- এটা সভ্য সমাজে কল্পনাও করা যায় না। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর মব কালচার এত বেশি তীব্র আকারধারণ করল কেন? এখানে প্রশাসনিক ব্যবস্থা কোথায়? এটা তো মানুষ আজ জানতে চায়।

তিনি বলেন, মব কালচারের কারণে দেশে আজ স্বামী-স্ত্রী-সন্তানসহ হত্যা করা হচ্ছে। প্রতিদিন বীভৎস হত্যাকাণ্ড ঘটছে। এটা তো অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা করে না মানুষ।

বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় সাবেক চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর যে ‘মব কালচার’ তীব্র আকারে দেখা যাচ্ছে তা মোকাবিলায় সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

সরকারের দুর্বলতা কোথায় যে, ‘মব কালচার’ প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। সাবেক এই চিফ হুইপ বলেন, সবকিছুর ঊর্ধ্বে বড় প্রাপ্তি যেন-মব কালচার। যে কাউকে, যেকোনো জায়গায়, মেরে মাটিতে শুইয়ে ফেলা এখন আর কোনো বিষয় নয়। কেবল একটা ট্যাগ দিয়ে দিলেই হলো। কেউ কিছু বলবে না। পুলিশ চেয়ে চেয়ে দেখবে, কিন্তু কিছু বলার সাহস পাবে না।

তিনি বলেন, কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে বা তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থাকলে দেশের প্রচলিত আইনে তার বিচার হবে। বিচার ব্যতিরেকে ‘মব’ সৃষ্টি বা জনতার হাতে আইন তুলে নিয়ে হত্যার ঘটনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর দৃষ্টান্ত। ‘মব’ সৃষ্টির এ ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথকে আরও জটিল করে তুলবে।

তিনি আরও বলেন, আইনের শাসনের পরিবর্তে ‘মব কালচার’কে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার প্রচ্ছন্ন সংকেত দেয়। এ ঘটনায় সরকারের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। যারা ‘মব সৃষ্টি করে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।