পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে ‘ওরা ১১ জন’ হিসেবে চিহ্নিত চাঁদাবাজ!

এম রাসেল সরকার-অনুসন্ধানী প্রতিবেদন:
পরিবহন খাত নিয়ে চাঁদাবাজি কিংবা অশুভ শক্তির দৌরাত্ম্যের খবর নতুন কিছু নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটেও কী করে এই খাতটিতে চাঁদাবাজদের আস্ফালন চলছে? আমরা দেখেছি, ক্ষমতাচ্যুত সরকারের শাসনামলে অন্যান্য খাতের তুলনায় অধিকতর নৈরাজ্য পরিলক্ষিত হয় পরিবহন খাতে। আমরা যদি আরও একটু পেছনে ফিরে তাকাই তাহলে স্পষ্টতই দেখতে পাই, প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক সরকারের শাসনামলেই পরিবহন খাতে অশুভ শক্তির থাবা বিস্তৃত হয়েছে। কিন্তু এখন তো পরিস্থিতি ভিন্ন।
অনিয়ম-অনাচারসহ বৈষম্যবিরোধী নেতিবাচক সবকিছুর বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলন শেষ পর্যন্ত একটি ইস্যুতে পরিণত হয় এবং এর পরিণাম শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ায়, তা বিস্মৃত হওয়ার নয়।
রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে অভিযান পরিচালনা করে দুদকের সহকারী পরিচালক আল-আমিন ও সুভাষ চন্দ্র মজুমদারের নেতৃত্বে একটি। অভিযানের বিষয়ে দুদক কর্মকর্তা আল আমিন বলেন, ছদ্মবেশে সায়েদাবাদ বিভিন্ন কাউন্টারে সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়েছে। এ সময় প্রতিটি বাস ছাড়ার সময়ে গাড়ি প্রতি ২০০-৩০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। ওই চাঁদা উত্তোলন করা হয় মালিক সমিতির স্লিপের মাধ্যমে। চোখ ফাঁকি দিতে রশিদে টাকার পরিমাণ লেখা হয় না, তবে নাম ও বাস নম্বর লিখে রশিদ দেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। অন্যদিক মহাখালী ও গাবতলী বাস টার্মিনালে দুদকের সহকারী পরিচালক মাহমুদ ও খোরশেদের নেতৃত্বে দুটি টিম অভিযান পরিচালনা করে।
দুদক জানায়, অভিযানে দুদকের তিনটি টিম টিকিট কাউন্টার অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ পেয়েছে যাত্রীদের কাছ থেকে। টিকিটের গায়ে নির্ধারিত দামের বেশি টাকা যাত্রীদের কাছ থেকে আদায়ের প্রমাণ মিলেছে। এসব বিষয় যাচাই করতে মালিক সমিতির অফিসে দুদক টিম গেলে সেখানে তালা দেওয়া পাওয়া যায় কিংবা সমিতির কোনো কর্মকর্তা বা নেতা অফিসে পাওয়া যায়নি।
তবে মালিক সমিতির প্রতিনিধিরা দুদক টিমকে বলেন, সমিতির নামে উত্তোলিত টাকা দ্বারা শ্রমিকদের বেতন ও সমিতির খরচ মেটানো হয়। অভিযানকালে সমিতি কোনো নেতার সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। সমিতির এমন কাজের বৈধতা পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন কমিশনে দাখিল করা হবে বলে জানিয়েছে দুদকের জনসংযোগ দপ্তর।
ভিন্ন প্রেক্ষাপটেও পরিবহন খাত যে অশুভ শক্তির ছায়ামুক্ত হয়নি, এরই কদর্য চিত্র ফের উঠে এসেছে, বলা হয়েছে, চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যে বেসামাল অবস্থা বিরাজ করছে পরিবহন খাতে। ক্ষমতার পালাবদলে কিছুদিন এ খাতের বলবানরা দমে থাকলেও তারা পুনর্বার মহাসমারোহে শুরু করেছে তাদের দুষ্কর্ম। এর খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ পরিবহন ব্যবসায়ীদের।
সাধারণ পরিবহন ব্যবসায়ীদের বক্তব্যের সূত্র ধরে ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মালিক সমিতি, শ্রমিক সংগঠন, পুলিশ আর বিআরটিএর বলবানদের চাঁদাবাজিতে তারা অতিষ্ঠ। পরিবহন মালিকদের উল্লেখযোগ্য অংশের অভিযোগ, বিআরটিএতে ঘুষের হার এখন আরও অনেক বেড়ে গেছে।
রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিআরটিএর অসাধুদের তুষ্ট করতে পারলেই যেকোনো অনিয়ম বৈধতা পেয়ে যায়! সংস্থাটির জনৈক পরিচালক কিছুদিন আগে সংবাদমাধ্যমের কাছে এসব ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন এবং একই সঙ্গে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে না পারার অক্ষমতার কথাও তিনি জানান। বিগত দিনের সিন্ডিকেটের ফের সক্রিয়তার ফলে খাতটিতে এখন যে নৈরাজ্য পরিলক্ষিত হচ্ছে তা একদিকে অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অন্যদিকে প্রশ্ন দাঁড়ায়, তাদের খুঁটির জোর কোথায়? ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার জানান, ‘পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে তারা হিমশিম খাচ্ছেন।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা কোনোরকম নিয়মনীতি কিংবা আইনকানুনের তোয়াক্কাই করছেন না। সপ্তাহে গড়ে প্রায় কুড়ি হাজারের মতো মামলা হচ্ছে এবং এরপরও যার যেমন খুশি তেমন চলছে। গাড়ি আটক করে ডাম্পিং করার পর্যাপ্ত জায়গাও নেই।’ আক্ষেপের সঙ্গে তিনি এও বলেন, ‘ভাই লিখে দেন পুলিশ কোনো কাজ করছে না। তারা ব্যর্থ।’ অনুসন্ধানে পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে ‘ওরা ১১ জন’ হিসেবে চিহ্নিত চাঁদাবাজ নেতাদের নাম উঠে এসেছে। তাদেরও আবার গডফাদার হিসেবে রয়েছে পাঁচ-ছয়জন, যারা সব সময়ই থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিযোগ আছে, যখন যে দল ক্ষমতায় যায় চাঁদাবাজ বাহিনী কোনো না কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের অনেককেই ‘ম্যানেজ’ করে নেয়।
দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াতে রাজধানীতে তিনটি টার্মিনাল নির্ধারিত থাকা সত্ত্বেও আরও অর্ধশতাধিক আন্তঃজেলা বাসস্ট্যান্ড এবং পাঁচ শতাধিক টিকিট কাউন্টার রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে রয়েছে, এও উঠে এসেছে অনুসন্ধানে। এসব কাউন্টার থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় তিন হাজার পারমিটবিহীন বাস ‘ম্যানেজ’ করে প্রতিদিন চলাচল করছে। পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্ট বলবানদের ‘ম্যানেজ’ করার পাশাপাশি বিআরটিএ এবং পুলিশের অসাধুদের সঙ্গে বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে নিয়ম ভেঙে নানারকম কর্মকাণ্ড চলছে। টিআইবির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের আন্তঃজেলা-দূরপাল্লার রুটে চলাচলকারী বাসগুলো থেকে চাঁদাবাজরা যে টাকা তোলেন তা বছরের হিসেবে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি। এ ব্যাপারে বিআরটিএর দায়িত্বশীলদের বক্তব্য দায়সারা গোছের। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বলেন, ‘পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির বিষয়টি দীর্ঘদিনের একটি সমস্যা। বিষয়গুলো তদারকি করে প্রকৃতপক্ষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কারণ, চাঁদাবাজি প্রতিরোধের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিষয়টি জড়িত। চাঁদাবাজির সঙ্গে সড়ক বিভাগের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী জড়িত থাকলে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব। আমরা এই খাতে স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা করছি।
পরিবহন খাতে বিরাজমান বিশৃঙ্খলার কারণে নিরাপদ ও যাত্রীবান্ধব সড়ক ব্যবস্থাপনায় যে অভিঘাত লেগেছে এর বিরূপ প্রভাব কতটা বহুমাত্রিক হয়ে দাঁড়িয়েছে এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নতুন করে নিষ্প্রয়োজন।
রাজনৈতিক সরকারের শাসনামলে রাষ্ট্র পরিচালনাকারী অনেকের একই সঙ্গে রাজনৈতিক বলবানদের সঙ্গে দফারফা করে অশুভ শক্তি যে দুর্বৃত্তপনা চালায় সেরকম প্রেক্ষাপট তৈরির কোনো অবকাশ বর্তমানে না থাকলেও পরিবহন খাতে কীভাবে নৈরাজ্য ফের মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে এর উৎস সন্ধান জরুরি। অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারসহ বিরাজমান অশুভ ছায়া নিরসনে যখন নানারকম প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে তখন পরিবহন খাতে কেন এই পরিস্থিতি বিরাজ করছে এ প্রশ্নের উত্তর সন্ধানও সমভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তন ঘটলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে অশুভ শক্তির আগ্রাসী থাবা এখনও কতটা বিস্তৃত, পরিবহন খাত এরই একটি নজির মাত্র। শুধু রাজধানী ঢাকাই নয়, দেশের অন্যান্য বিভাগ এবং জেলায়ও প্রায় একই চিত্র বিরাজ করছে এ বার্তাও নিকট অতীতে সংবাদমাধ্যমেই মিলেছে।
যেকোনো সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড নাগরিক সমাজের কাছে গুরুতর ব্যাধিসম। এই ব্যাধি সংক্রামক এবং এর উপসর্গগুলো সমাজজীবনে বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধকতা-অস্থিরতা-নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি করে। আমরা জানি, আমাদের সমাজে কিছু ব্যাধি আছে যেগুলো শুধু সামাজিক পরিসরেই নানারকম অশান্তি কিংবা নিরাপত্তাহীনতার কারণ নয়, রাজনৈতিক অঙ্গনেও এর বহুমাত্রিক বিরূপ প্রভাব দৃশ্যমান হয়। পরিবহন খাতে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সৃষ্ট প্রেক্ষাপটে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা অনিভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত এবং কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। এও আমাদের অজানা নয়, রাজনৈতিক অস্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি থেকে সৃষ্ট অপরাধের বহুমাত্রিক চিত্র রাষ্ট্রসমাজে ফিরে ফিরে বৈরী পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। আমরা কোনোভাবেই এর পুনরাবৃত্তি চাই না, বরং প্রত্যাশা করি সমাজবিরোধীদের মূলোৎপাটনের পাশাপাশি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় কঠোর কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
আমরা এও ধারণা করি, অনিয়ম-স্বেচ্ছাচারিতা কিংবা দুষ্কর্মের দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিবিধান দৃশ্যমান করা যায়নি বলেই অপশক্তির ছায়া এখনও জিইয়ে আছে। আমরা দ্রুত এর নিরসন চাই। আমরা আরও মনে করি, নানামুখী সংস্কারের প্রবাহের মধ্যে পরিবহন খাত এর বাইরে থাকা ঠিক নয়। পরিবহন খাতের সমস্যা যেহেতু নতুন নয় এবং এর ক্ষত অনেক গভীর সেহেতু পরিস্থিতির উন্নয়নে নজর গভীর করা জরুরি। এক কথায় পরিবহন খাতে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হলে সব ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নির্মূল করতে হবে।