স্টাফ রিপোর্টার:
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান এককভাবে কোন রাজনৈতিক দল বা সংগঠন কিংবা ব্যক্তির নয়। এটি বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা-শ্রমিকসহ বিএনপি-জামায়াত, মুক্তিকামী রাজনৈতিক দল, ছাত্র-সংগঠন, স্বশস্ত্র বাহিনী, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অংশ বিশেষ, সিভিল সোসাইটি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইনজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের সম্মিলিত গণঅভ্যুত্থান। যে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিদায় নিতে বাধ্য হয়। এখন কোন শক্তি যদি এককভাবে দাবি করে যে, গণঅভ্যুত্থান তারা নেতৃত্ব না দিলে সংঘটিত হতো না মূলত তারা অন্ধকারে আছেন।
মনে রাখতে হবে, কোটার মতো সামাজিক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছাত্ররাই বিভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। নাহিদ-আসিফ-কাদেরা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনার ক্ষমা প্রার্থণা সংক্রান্ত ৯দফা, আর সারজিস, হাসনাত এবং হাসিবরা আওয়ামী লীগের তিনমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করে দিয়েছিলেন ৮দফা। এই দ্বিধাবিভক্ত দুই অংশের ৬জন সমন্বয়ককে সরকারের সাথে সমঝোতা করার জন্য ডিবি হারুণের হেফাজতে নিয়ে কিন্তু প্রায় ১২দিন রাখা হয়েছিলো। তখনো কিন্তু আন্দোলন থামেনি। দুর্বার গতিতে রাজনৈতিক শক্তি আন্দোলন টেনে নিয়ে গিয়েছিলো। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ১৬ জুলাই আবু সাঈদ, ওয়াসিমরা শহীদ হলে হাসিনা পতনে এক দফার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ২১ জুলাই দফা এক দাবি এক, খুনী হাসিনার পদত্যাগ ঘোষণা পুনরায় দেন জনাব তারেক রহমান।
৬ সমন্বয়ক হেফাজতে থাকা অবস্থায় আন্দোলনকে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, কৃষকদল, মহিলা দলসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের কয়েকটি পয়েন্টে আন্দোলন ভাগ করে দেন। যখন ৬ সমন্বয়ককে জোর করে ডিবি হেফাজতে রাখা অবস্থায় আন্দোলন স্থগিত করার ঘোষণা দেয়া হয়, তখনো কিন্তু আন্দোলন সারাদেশে স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে। কার্যত তখন আর আন্দোলন ছাত্রদের হাতে ছিলো না। একটি বিশেষ সাইবার নেটওয়ার্ক থেকে ডিবি হারুন এবং নানকের সেক্স স্ক্যান্ডাল সোস্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়া হয়। যেটির কারণে হারুণ এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের মনোবল ভেঙ্গে যায়।
সাবেক ছাত্ররা যারা জুলাই-আগষ্ট গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিলো তারা কিন্তু ৩রা আগস্টের আগে কখনোই হাসিনার পদত্যাগ দাবি করেনি। এ সংক্রান্ত কোন প্রমাণ তারা দেখাতে পারবে না। কিন্তু বিএনপির পক্ষ ১লা আগষ্ট হাসিনা পতনে চূড়ান্ত অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন জনাব তারেক রহমান। যে বাস্তবায়নে রাজপথে ঝাঁপিয়ে বিএনপির লাখ লাখ নেতাকর্মী-শুভাকাঙ্খিরা। ৩রা আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন হাসিনা পতনের জন্য ৬ আগস্ট ঢাকায় অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়; তখন কিন্তু আন্দোলন একদিন এগিয়ে ৫ আগস্ট করা হয় বিএনপির পরামর্শে। সেই মোতাবেক হাসিনাকে বিতাড়িত করে ছাত্র-জনতা।
হাসিনা পতনের পর বিএনপি কখনো দাবি করেনি যে, হাসিনার পতন সংগঠন হিসেবে এককভাবে করেছে। বরং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যাান এবং বিএনপির মহাসচিব বারবার বলেছে, এটি সকলের আন্দোলনের ফসল। এটি একক কারোর আন্দোলন ছিলো না। কিন্তু নবগঠিত ছাত্র সংগঠন বারবারই জুলাই-আগস্টকে তারা নিজেদের একক আন্দোলন হিসেবে দাবি করে আসছে যা অত্যন্ত দু:খজনক। বরং এই আন্দোলনে বিএনপি এবং অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের মতো জামায়াত-শিবিরের অবদান অস্বীকার করার সুযোগ নাই। অন্যান্যদের অবদান তো আছেই। তবে হাসিনার পতন কিন্তু ৩৬দিনের আন্দোলনের সফল নয়। এটি ছিলো ১৭ বছরের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ। সেই ক্ষোভের বহি:প্রকাশ হলো ৫ই আগস্ট। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান নিয়ে কৃতিত্বের রাজনীতি ভালো কিছু বয়ে আনবে না।
আরো একটি বিষয় জেনেনে রাখা ভালো যে, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে সবচেয়ে বেশি তথা চার শতাধিক শহীদের দল বিএনপি (১৪০ জনেরও বেশি ছাত্রদলের), সবচেয়ে বেশি আহত ও পঙ্গু নেতা-কর্মীর দল বিএনপি, সবচেয়ে বেশি রাজপথের যোদ্ধার দলও বিএনপি। রেইড চালিয়ে পল্টনসহ দেশজুড়ে বিএনপির অফিসগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, গ্রেফতার করা হয়েছিল হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে, রিমান্ডে নিয়ে চালানো হয়েছিল পাশবিক নির্যাতন।রাজপথে সক্রিয় ছিলেন বিএনপির সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা, অঙ্গ-সহযোগী ও পেশাজীবী প্রতিটি সংগঠনের সদস্য এবং নিবেদিতপ্রাণ সমর্থকেরা; ঠিক যেমন নেমে এসেছিলেন বাংলাদেশের প্রতিটি শ্রেণি, পেশা ও অবস্থানের ফ্যাসিবাদবিরোধী মানুষ। ভূমিকা রেখেছিলেন দেশ-প্রবাসের অগণিত অন্তঃপ্রাণ দেশপ্রেমিকরাও।
এই গণঅভ্যুত্থান সবার; প্রতিটি গণতন্ত্রকামী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দলের। অথচ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শ্রমজীবী মানুষ ও নারীদের ভূমিকাকে অনেকটা পাশ কাটিয়ে, গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব ও কৃতিত্ব নিয়ে নানামুখী ন্যারেটিভ তৈরী হচ্ছে। ক্রেডিট নিয়ে কাড়াকাড়ি, কিংবা শহীদ-ত্যাগীদের অবমূল্যায়ন করে রাষ্ট্রক্ষমতার ভোগ-মোহো, কোনোভাবেই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্খা ছিল না।
তবে এটি চিরন্তন সত্য হলো, ছাত্ররা ছাত্রলীগের ভয়কে উপেক্ষা করে যেভাবে জয় করেছে সেটি খাটো করবার নূন্যতম সুযোগ নেই। তারা ফ্রন্টলাইনে থেকে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলো। কিন্তু ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকে যেভাবে আওয়ামী লীগ দলীয় সম্পদ মনে করে ভোগ করেছিলো, ঠিক সেই একই পথ নতুন দলের অনুসরণ হবে ভয়ংকর। আন্দোলনে কার ভূমিকা কি, কে কি করেছিলো সেটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এটি নিয়ে বারবার রাজনীতি করবার কিছুই নাই। এনসিপি যেভাবে বয়ান দিচ্ছে বাস্তবতা তেমন ছিলো না। আপনারা ১২দিন ছিলেন না, আন্দোলন কি হয় নাই? আপনারা ডিবি হেফাজতে আন্দোলন স্থগিত করেছিলেন কিন্তু তা কি থেমে ছিলো? আপনাদের এনসিপিতে যেসব লোকদের পদ দিয়েছেন সবাই কিন্তু আন্দোলনে ছিলো না-আমরা কি একবারও প্রশ্ন করেছি? অতএব গণঅভ্যুত্থানের পর বিশেষ সুবিধা নেয়া মানে অভ্যুত্থানকে বিতর্কিত করা? আশা করবো গণঅভ্যুত্থান নিয়ে কারোর রাজনীতি করা ঠিক হবে না। বরং গণভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি যদি দুর্বল হয়ে যায় তাহলে ফ্যাসিবাদ ফিরে আসবে। তখন কিন্তু সকলের জন্য পরিনাম ভালো হবে না।
বাংলাদেশের আপামর জনতা জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলো হাসিনার অপশাসন থেকে মুক্তির জন্য। গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, মানবাধিকার নিশ্চিত করবার জন্য। আমরা কি আদৌও সেটি করতে পেরেছি? বরং দীর্ঘকাল ভোটবঞ্চিত জনগণকে নির্বাচনে দিকে উৎসাহিত করা সকলের নৈতিক দায়িত্ব এবং কতর্ব্য। নির্বাচন হলো বাংলাদেশের জন্য এই মূহুর্তে সবচেয়ে বড় সংস্কার। সেই সংস্কার যদি কেউ আটকে রাখতে চায়, তাহলে তারা ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। সকলে সাবধান। আগুন নিয়ে খেলতে নাই। কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে, ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার এরশাদের পতন হয় ১৯৮৬, ১৯৮৮ সালের দু’টি বিতর্কিত নির্বাচনের কারণে। একইভাবে হাসিনার বিদায় হয়েছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাতের ভোট এবং ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি ডামি নির্বাচনের কারণে। মৌলিক সংস্কার শেষে নির্বাচন একমাত্র সমাধান। অবশ্যই সেটি যেনতেন নির্বাচন নয়। ফ্যাসিবাদ ছাড়া সকলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্র্বাচন বাংলাদেশ বির্নিমানে অত্যন্ত জরুরি। এই মুহুর্তে দরকার নির্বাচিত সরকার।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
যোগাযোগ: সম্পাদক ও প্রকাশক: মো: রাসেল সরকার, অফিস: ৩৯/৩, মানিক নগর, পুকুর পাড়, মুগদা, ঢাকা - ১২০৩, ফোন: +৮৮০১৭২৬৯১৫৫২৪, +৮৮০১৯৭৬৯১৫৫২৪, ইমেইল: Sheikhmdraselbd@gmail.com, www.dailydigantapratidin.com
2025 © All rights reserved © দৈনিক দিগন্ত প্রতিদিন