এই তরুণদের সবাই ছিলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, তিনি খাবার দিয়ে সহযোগিতা করতেন

এম রাসেল সরকার:
স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য এ দেশের সর্বস্তরের মানুষ যার যার স্থান থেকে কাজ করেছেন। যারাই স্বাধিকারের জন্য কাজ করেছেন তারাই পাকিস্তানি শাসকদের চক্ষুশূল হয়েছেন, এসেছে বাধা, শিকার হয়েছেন নানা অত্যাচারের। তবু অসীম সাহসী কিছু মানুষ দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছেন মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে। সাংবাদিক সেলিনা পারভীন তাদেরই একজন।
৭১-এর শত্রুপরিবেষ্টিত সেই ঢাকায় অবস্থান করেই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ, ওষুধ ও প্রয়োজনীয় জিনিসের জোগান দিয়েছেন।
সেলিনা পারভীনের জন্ম ১৯৩১ সালের ৩১ মার্চ নোয়াখালী জেলার রামগঞ্জ উপজেলার ছোট কল্যাণনগর গ্রামে। বাবা মৌলভী আবিদুর রহমান এবং মা মোসাম্মৎ সাজেদা খাতুন। তার প্রকৃত নাম মনোয়ারা বেগম। ১৯৫৪ সালে তিনি এফিডেভিট করে সেলিনা পারভীন নাম গ্রহণ করেন।
তিনি ফেনীর সরলা বালিকা বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। নানা প্রতিকূলতার কারণে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ১৯৪২ সালে নিজ গ্রাম ছোট কল্যাণনগরে চলে আসেন। ১৯৪৯ সালে তিনি প্রাইভেটে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেন। কিন্তু কৃতকার্য হতে পারেননি। ১৯৪৫ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার মোহনগঞ্জে থাকার সময় কলকাতা নিবাসী শিক্ষয়িত্রী উমার সাহচর্য লাভ করেন। তিনি তাকে সাহিত্য সাধনায় অনুপ্রাণিত করেন। কবিতা দিয়ে তার সাহিত্যের পথে যাত্রা শুরু হয়। বিভিন্ন সময়ে নিবন্ধ ও প্রতিবেদন প্রকাশ করতেন।
তার লেখা সে সময়ের পত্রিকা পূর্বদেশ, আজাদ, দৈনিক পাকিস্তান, সংবাদ, ইত্তেফাক ও বেগম পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
পত্রিকায় লেখালেখির পাশাপাশি তিনি ১৯৫৭ সালে মিটফোর্ড হাসপাতালে নার্সিং প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৫৯ সালে রোকেয়া হলে কিছুকাল মেট্রনের চাকরি করার পর ১৯৬০-৬১ সালে আজিমপুর বেবিহোমে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬৫ সালে সলিমুল্লাহ এতিমখানায় কিছুদিন চাকরি করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকায় সম্পাদকের সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৭ সালে যোগ দেন সাপ্তাহিক ললনা পত্রিকায়। এ সময় থেকেই নিবন্ধ রচনা ও সাংবাদিকতায় দক্ষতা অর্জন করেন।
১৯৬৯ সালে তার একক প্রচেষ্টায় সম্পাদিত ও প্রকাশিত হয় শিলালিপি পত্রিকা। ছবি আঁকা, সংগীতচর্চা, ব্লক তৈরি এবং ডিজাইনের কাজে নিজেকে যুক্ত রাখতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার শিলালিপি পত্রিকার প্রচ্ছদ ও বিভিন্ন রচনা পাকিস্তানি সেনাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকারদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি ছিল শিলালিপি। পত্রিকাটি বিক্রির অর্থ দিয়ে তিনি সেই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ওষুধ, অর্থ, খাবার দিয়ে সহযোগিতা করতেন। একপর্যায়ে শিলালিপির প্রকাশিত সব সংখ্যা নিষিদ্ধ করেছিল পাকিস্তান সরকার। ১৯৬৯-এর রাজনৈতিক আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশ।
নিজেও শরিক হন গণ-অভ্যুত্থানের আন্দোলন কর্মকাণ্ডে। ছেলেকে সঙ্গে নিয়েই বেরিয়ে পড়তেন ৬৯-এর ২১ ফেব্রুয়ারি পল্টনের জনসভায় বা শহিদ মিনার থেকে বের হওয়া নারীদের মিছিলে যোগ দিতে। শরিক হতেন বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদ সভাতেও অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার প্রমুখদের সঙ্গে।
তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে সমাজতন্ত্রের প্রতিও আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। ইতোমধ্যে শুরু হয় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেলিনা পারভীন ঢাকায় ছিলেন। তার বাসায় মাঝে মধ্যে রাত হলে কয়েকজন তরুণ আসতেন। এই তরুণদের সবাই ছিলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা। খাওয়া-দাওয়া করে চলে যাওয়ার আগে তারা সেলিনা পারভীনের কাছ থেকে সংগৃহীত ওষুধ, কাপড় আর অর্থ নিয়ে যেতেন। শিলালিপির বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়েই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন। তার এসব কর্মকাণ্ড শত্রুর জন্য বিপজ্জনক ছিল বলেই আলবদরদের তালিকায় তার নাম ওঠে।
সেলিনা পারভীনকে একাত্তরের ১৩ ডিসেম্বর আলবদর বাহিনীর সদস্যরা সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। ১৪ ডিসেম্বর আলবদর বাহিনী যে বিপুলসংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে হত্যা করে, সেলিনা পারভীন তাদের একজন। ওই বধ্যভূমিতে চোখ বাঁধা অবস্থায় পড়েছিল তার লাশ। তাকে ১৮ ডিসেম্বর আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
এম রাসেল সরকার
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।
ইমেইল- Sheikhmdraselbd@gmail.com