3:44 pm, Tuesday, 9 September 2025

সিন্ডকেট করে টাকা আত্মসাৎ ও লুটপাট মৌলভীবাজারে মহিলা অধিদপ্তর

picsart 25 01 26 18 22 35 731

 

এম রাসেল সরকার:
মৌলভীবাজার মহিলা অধিদপ্তরে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তা শাহেদা আক্তারের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।

প্রশিক্ষণার্থীদের ভাতার টাকা আত্মসাৎ, অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে টাকা উত্তোলন, কাঁচামাল কেনার নামে প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায়সহ ভর্তি ফরমের টাকা সিন্ডিকেট করে ভাগবাটোয়ারাসহ দুর্নীতির মহোৎসব চলছে এ কার্যালয়ে অনুসন্ধানে এমন চিত্র উঠে এসেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দীর্ঘ সাড়ে আট বছর ধরে জেলা কর্মকর্তা না থাকায় শ্রীমঙ্গল উপজেলা কর্মকর্তা শাহেদা আক্তার অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। এর বাইরেও তিনি জুড়ী ও শ্রীমঙ্গল ডে-কেয়ারের দায়িত্বে রয়েছেন। এ চারটি অফিস থেকেই লুটপাট করছেন শাহেদা আক্তার।

তিনি একাই পুরো জেলা নিয়ন্ত্রণ করতে চান। শ্রীমঙ্গল ডে-কেয়ার সেন্টারে বাচ্চাদের খাবারের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পাইলট প্রকল্পের আওতায় জুড়ী উপজেলায় আইসি ভিজিটি মহিলাদের এককালীন ২০ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা। কিন্তু তাদের টাকা কম দিয়ে এ প্রকল্প থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকা লুট করেছেন তিনি। জেলা কার্যালয়ে ডিসপ্লে সেন্টারের ডেকোরেশনের জন্য পাঁচ লাখ টাকা বরাদ্দ এলেও নামকাওয়াস্তে কাজ করে অর্ধেকের বেশি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

জেলা কার্যালয় এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন শাহেদা আক্তার ও অফিস সহকারী দেলোয়ার হোসেন। চাকরির শুরু থেকে (২৪ বছর) অফিস সহকারী দেলোয়ার মৌলভীবাজার কার্যালয়ে কর্মরত। দেলোয়ার অফিস সহকারী হয়েও হিসাবরক্ষকের যাবতীয় কাজ করছেন। অথচ অফিসে হিসাবরক্ষক পদে মোহাম্মদ জিয়া উদ্দিন ও মো. লতিফুল ইসলাম নামে দুজন রয়েছেন।

দুর্নীতি করে শাহেদা আক্তার টাঙ্গাইলে বিল্ডিং এবং দেলোয়ার নিজ বাড়িতে পাকা ঘর করেছেন। প্রাকটিক্যালের কাঁচামাল কেনার কথা বলেও প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হচ্ছে। অথচ সংশ্লিষ্ট ট্রেডের কাঁচামাল কেনার জন্য সরকারি বরাদ্দ রয়েছে। সরজমিনে অনুসন্ধানে জানা যায়, জেলায় ৭২টি কিশোর-কিশোরী ক্লাব চলমান। সপ্তাহে শুক্র-শনিবার ৩০ জনকে এ ক্লাবে সাংস্কৃতিক নানা বিষয় শেখানোর কথা। কিশোর-কিশোরীদের ক্লাবমুখী করার জন্য প্রতিদিন প্রত্যেক সদস্যের জন্য ৩০ টাকা মূল্যের স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন নাস্তা বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু কিশোর-কিশোরীদের নাস্তাতেও হরিলুট করছেন কর্মকর্তারা। স্বাস্থ্যসম্মত নাস্তার পরিবর্তে দেওয়া হচ্ছে নিম্নমানের নামকাওয়াস্তে খাবার। ক্লাবে ৩৫ প্যাকেট নাস্তার পরিবর্তে দেওয়া হচ্ছে ১৫-২০ প্যাকেট। ফিল্ড সুপারভাইজার দেবজিৎ দে ‘নিউ সততা এন্টারপ্রাইজ’ নামে ট্রেড লাইসেন্স করে প্রশিক্ষণার্থীদের নাস্তার টাকা আত্মসাৎ করছেন।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসে জমা দেওয়া একটি ক্যাশ মেমো যুগান্তরের কাছে এসেছে। ওই মেমো দিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে সদর উপজেলার ক্লাবের কিশোর-কিশোরীদের নাস্তার জন্য ৯৩ হাজার ৬০০ টাকা তোলা হয়। ক্যাশ মেমোতে দেখা যায়, ফিল্ড সুপারভাইজার দেবজিৎ দে’র ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বর।

মৌলভীবাজার পৌর শহরের কাশীনাথ রোডে এ প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দেওয়া থাকলেও সেখানে ‘নিউ সততা এন্টারপ্রাইজ’ নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। একই মাসে পৌর শহরের কুসুমবাগ এলাকার ‘মৌসুমী এন্টারপ্রাইজ’ নামে আরও একটি প্রতিষ্ঠানের নামে ৯৫ হাজার ১৫০ টাকার একটি ক্যাশ মেমো জমা দেওয়া হয়। প্রতিবেদক কুসুমবাগ শপিং সিটিতে গিয়ে এ প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাননি।

একই মাসে ‘পড়শী ভেরাইটিজ স্টোর’ নামে ৯৯ হাজার ৮৪০ টাকার আরও একটি মেমো জমা দেওয়া হয়েছে। মেমোতে ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নম্বরে কল দিয়ে অনিক চন্দ্র পালের সঙ্গে দেখা করে জানা যায়, সেখানে তার শিল্পা কম্পিউটার নামে প্রিন্টিংয়ের একটি দোকান রয়েছে। তিনি বলেন, ‘পড়শী ভেরাইটিজ স্টোর নামে আমার কোনো দোকান নেই। কে বা কারা আমার নাম ও মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে বিল বানিয়েছেন আমার জানা নেই।’

দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ২০১৮ সাল থেকে জেলা কর্মকর্তা শাহেদা আক্তার, ফিল্ড সুপারভাইজার দেবজিৎ দে ও অফিস সহকারী মো. দেলোয়ার হোসেন সিন্ডিকেট করে কিশোর-কিশোরী ক্লাবের লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। সূত্র বলছে, কিশোর-কিশোরী ক্লাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত ইউপি সদস্যদের সম্মানি ভাতা গত এক বছর ধরে দেওয়া হচ্ছে না।

পুরোটাই আত্মসাৎ করছে এ সিন্ডিকেট। বিগত তিন ধাপের বন্যায় দীর্ঘদিন ক্লাব বন্ধ ছিল। সে সময়ও বিল তোলা হয়েছে। জেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শাহেদা আক্তার বলেন, ‘বিল নিয়ে আসতো, আমি স্বাক্ষর করে দিতাম। এভাবে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে টাকা উত্তোলন করা হচ্ছে জানতাম না।’ প্রশিক্ষণার্থীদের কম টাকা দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এরকম তো হওয়ার কথা নয়। অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের বিষয়ে তিনি বলেন, সিলেট বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তা না থাকায় লোক সংকট। এজন্যই অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছি।

বিস্তারিত আসছে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

Update Time : 12:26:35 pm, Sunday, 26 January 2025
148 Time View

সিন্ডকেট করে টাকা আত্মসাৎ ও লুটপাট মৌলভীবাজারে মহিলা অধিদপ্তর

Update Time : 12:26:35 pm, Sunday, 26 January 2025

 

এম রাসেল সরকার:
মৌলভীবাজার মহিলা অধিদপ্তরে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তা শাহেদা আক্তারের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।

প্রশিক্ষণার্থীদের ভাতার টাকা আত্মসাৎ, অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে টাকা উত্তোলন, কাঁচামাল কেনার নামে প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায়সহ ভর্তি ফরমের টাকা সিন্ডিকেট করে ভাগবাটোয়ারাসহ দুর্নীতির মহোৎসব চলছে এ কার্যালয়ে অনুসন্ধানে এমন চিত্র উঠে এসেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দীর্ঘ সাড়ে আট বছর ধরে জেলা কর্মকর্তা না থাকায় শ্রীমঙ্গল উপজেলা কর্মকর্তা শাহেদা আক্তার অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। এর বাইরেও তিনি জুড়ী ও শ্রীমঙ্গল ডে-কেয়ারের দায়িত্বে রয়েছেন। এ চারটি অফিস থেকেই লুটপাট করছেন শাহেদা আক্তার।

তিনি একাই পুরো জেলা নিয়ন্ত্রণ করতে চান। শ্রীমঙ্গল ডে-কেয়ার সেন্টারে বাচ্চাদের খাবারের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পাইলট প্রকল্পের আওতায় জুড়ী উপজেলায় আইসি ভিজিটি মহিলাদের এককালীন ২০ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা। কিন্তু তাদের টাকা কম দিয়ে এ প্রকল্প থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকা লুট করেছেন তিনি। জেলা কার্যালয়ে ডিসপ্লে সেন্টারের ডেকোরেশনের জন্য পাঁচ লাখ টাকা বরাদ্দ এলেও নামকাওয়াস্তে কাজ করে অর্ধেকের বেশি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

জেলা কার্যালয় এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন শাহেদা আক্তার ও অফিস সহকারী দেলোয়ার হোসেন। চাকরির শুরু থেকে (২৪ বছর) অফিস সহকারী দেলোয়ার মৌলভীবাজার কার্যালয়ে কর্মরত। দেলোয়ার অফিস সহকারী হয়েও হিসাবরক্ষকের যাবতীয় কাজ করছেন। অথচ অফিসে হিসাবরক্ষক পদে মোহাম্মদ জিয়া উদ্দিন ও মো. লতিফুল ইসলাম নামে দুজন রয়েছেন।

দুর্নীতি করে শাহেদা আক্তার টাঙ্গাইলে বিল্ডিং এবং দেলোয়ার নিজ বাড়িতে পাকা ঘর করেছেন। প্রাকটিক্যালের কাঁচামাল কেনার কথা বলেও প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হচ্ছে। অথচ সংশ্লিষ্ট ট্রেডের কাঁচামাল কেনার জন্য সরকারি বরাদ্দ রয়েছে। সরজমিনে অনুসন্ধানে জানা যায়, জেলায় ৭২টি কিশোর-কিশোরী ক্লাব চলমান। সপ্তাহে শুক্র-শনিবার ৩০ জনকে এ ক্লাবে সাংস্কৃতিক নানা বিষয় শেখানোর কথা। কিশোর-কিশোরীদের ক্লাবমুখী করার জন্য প্রতিদিন প্রত্যেক সদস্যের জন্য ৩০ টাকা মূল্যের স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন নাস্তা বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু কিশোর-কিশোরীদের নাস্তাতেও হরিলুট করছেন কর্মকর্তারা। স্বাস্থ্যসম্মত নাস্তার পরিবর্তে দেওয়া হচ্ছে নিম্নমানের নামকাওয়াস্তে খাবার। ক্লাবে ৩৫ প্যাকেট নাস্তার পরিবর্তে দেওয়া হচ্ছে ১৫-২০ প্যাকেট। ফিল্ড সুপারভাইজার দেবজিৎ দে ‘নিউ সততা এন্টারপ্রাইজ’ নামে ট্রেড লাইসেন্স করে প্রশিক্ষণার্থীদের নাস্তার টাকা আত্মসাৎ করছেন।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসে জমা দেওয়া একটি ক্যাশ মেমো যুগান্তরের কাছে এসেছে। ওই মেমো দিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে সদর উপজেলার ক্লাবের কিশোর-কিশোরীদের নাস্তার জন্য ৯৩ হাজার ৬০০ টাকা তোলা হয়। ক্যাশ মেমোতে দেখা যায়, ফিল্ড সুপারভাইজার দেবজিৎ দে’র ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বর।

মৌলভীবাজার পৌর শহরের কাশীনাথ রোডে এ প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দেওয়া থাকলেও সেখানে ‘নিউ সততা এন্টারপ্রাইজ’ নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। একই মাসে পৌর শহরের কুসুমবাগ এলাকার ‘মৌসুমী এন্টারপ্রাইজ’ নামে আরও একটি প্রতিষ্ঠানের নামে ৯৫ হাজার ১৫০ টাকার একটি ক্যাশ মেমো জমা দেওয়া হয়। প্রতিবেদক কুসুমবাগ শপিং সিটিতে গিয়ে এ প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাননি।

একই মাসে ‘পড়শী ভেরাইটিজ স্টোর’ নামে ৯৯ হাজার ৮৪০ টাকার আরও একটি মেমো জমা দেওয়া হয়েছে। মেমোতে ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নম্বরে কল দিয়ে অনিক চন্দ্র পালের সঙ্গে দেখা করে জানা যায়, সেখানে তার শিল্পা কম্পিউটার নামে প্রিন্টিংয়ের একটি দোকান রয়েছে। তিনি বলেন, ‘পড়শী ভেরাইটিজ স্টোর নামে আমার কোনো দোকান নেই। কে বা কারা আমার নাম ও মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে বিল বানিয়েছেন আমার জানা নেই।’

দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ২০১৮ সাল থেকে জেলা কর্মকর্তা শাহেদা আক্তার, ফিল্ড সুপারভাইজার দেবজিৎ দে ও অফিস সহকারী মো. দেলোয়ার হোসেন সিন্ডিকেট করে কিশোর-কিশোরী ক্লাবের লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। সূত্র বলছে, কিশোর-কিশোরী ক্লাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত ইউপি সদস্যদের সম্মানি ভাতা গত এক বছর ধরে দেওয়া হচ্ছে না।

পুরোটাই আত্মসাৎ করছে এ সিন্ডিকেট। বিগত তিন ধাপের বন্যায় দীর্ঘদিন ক্লাব বন্ধ ছিল। সে সময়ও বিল তোলা হয়েছে। জেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শাহেদা আক্তার বলেন, ‘বিল নিয়ে আসতো, আমি স্বাক্ষর করে দিতাম। এভাবে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে টাকা উত্তোলন করা হচ্ছে জানতাম না।’ প্রশিক্ষণার্থীদের কম টাকা দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এরকম তো হওয়ার কথা নয়। অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের বিষয়ে তিনি বলেন, সিলেট বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তা না থাকায় লোক সংকট। এজন্যই অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছি।

বিস্তারিত আসছে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে।